০৯:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ভা্রত- পাকিস্তান সম্পর্ক ইতিবাচক হবার সম্ভাবনা আরো ক্ষীন হলো

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫
  • 51

মালীহা লোধি

দুইটি সাম্প্রতিক ঘটনা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার উত্তপ্ত সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছেযা এই দুই দেশের সম্পর্কের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে আরও ক্ষীণ করে তুলেছে। প্রথম ঘটনা হলো বেলুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলা ও হাইজ্যাক এবং এরপর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বিবৃতি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি পডকাস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগযেখানে তিনি বলেনপাকিস্তান একটি প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে তার দেশের বিরুদ্ধে। এই কথার লড়াই নতুন কিছু নয়তবে এর পুনরাবৃত্তি দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক অচলাবস্থাকে আরও গভীর করে তুলেছে।

বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে বলেনভারতের পূর্ব দিকের প্রতিবেশী দেশ দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের সহিংসতা উসকে দিচ্ছে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এই অভিযোগগুলো ইসলামাবাদ বহুদিন ধরেই করে আসছে২০১৬ সালে আরডব্লিউএর কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদবের গ্রেপ্তারযিনি পাকিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হনতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। তিনি স্বীকার করেন যে পাকিস্তানে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলিকে সহায়তা করতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। ভারতের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং বলা হয় এই অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন” এবং পাকিস্তানকে নিজের ভেতরের দিকে তাকানো উচিত

লেক্স ফ্রিডম্যানের সঙ্গে একটি পডকাস্টেযা ১৬ মার্চ সম্প্রচারিত হয়প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ মন্তব্য করেনযা দুই দেশের মধ্যকার বিষাক্ত পরিবেশকে আরও বিষিয়ে তোলে। তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ এবং কথিত মিথ্যা শান্তি উদ্যোগকে দায়ী করেন। মোদির দাবিভারত শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলকিন্তু পাকিস্তান তা প্রতারায় পরিণত করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ গ্রহণ করেনি। তিনি পাকিস্তানকে অস্থিরতার কেন্দ্রস্থল” বলে অভিহিত করেন। এই ধরনের বক্তব্য নতুন নয়তবে এই সময় তা আরও উত্তেজনা তৈরি করেছে।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

প্রধানমন্ত্রী মোদির এই মন্তব্য আসলে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ভারতের তৈরি করা বর্ণনাকে আরও জোরালো করে তোলে। এতে সম্পর্কের অবনতির পুরো দায় পাকিস্তানের ওপর চাপানো হয় এবং স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করার দায়টিও তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটি সেই কৌশলের অংশযার মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছেযা ভারতের অনেকের দৃষ্টিতে একটি দুর্বল মুহূর্ত। বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয় মিডিয়ায় যেভাবে অতিমাত্রায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছেতাতে মনে হয়েছে এটি পূর্বপরিকল্পিত প্রচার।

এই পরিস্থিতি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে একটি অনিশ্চিত ও অস্থির অবস্থানে নিয়ে এসেছে। গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আনুষ্ঠানিক সংলাপ বন্ধ রয়েছে। বর্তমান উত্তেজনার বিষয়বস্তুর প্রকৃতি বিবেচনায় নিলেএকটি ব্যাকচ্যানেল (গোপন সংলাপের পথ) কার্যকর হতে পারে যাতে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং ভুল হিসাব-নিকাশ এড়ানো যায়।

ইসলামাবাদ এমন একটি প্রক্রিয়া চালু করতে আগ্রহী এবং এটি অনানুষ্ঠানিকভাবে ট্র্যাক টু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানানো হয়েছেযেখানে দুই দেশের সাবেক কর্মকর্তাসহ অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মতবিনিময় হয়। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি ট্র্যাক টু বৈঠকে পাকিস্তানের ব্যাকচ্যানেল প্রস্তাবে ভারত সাড়া দেয়নি। বরং তারা বলেছেএই বিষয়টি জুলাইয়ে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন বা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) সাইডলাইনে দুই নেতার বৈঠকে আলোচনা হতে পারেযদি সেই বৈঠক হয়।

সরকারি পর্যায়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হলোবর্তমানে বিদ্যমান ব্যবস্থাই যেকোনো সঙ্কট মোকাবিলা বা প্রতিরোধে যথেষ্ট এবং তাই আনুষ্ঠানিক ব্যাকচ্যানেল প্রয়োজন নেই। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় অতীতে উত্তেজনা বেড়ে গেলে রাওয়ালপিন্ডি ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে যেসব যোগাযোগ হয়েছে তা থেকে। এমন একটি ঘটনা ছিল ২০২২ সালের মার্চেযখন ভারত ভুলবশত একটি ব্রাহমোস ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তানের মিয়ান চান্নুতে নিক্ষেপ করে। সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল এবং বড় ধরনের সঙ্কট এড়ানো গিয়েছিল।

পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপ পুনরায় শুরু করার পথে একাধিক বাধা রয়েছে। সবচেয়ে বড় বাধা হলোঅধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে অমোচনীয় ব্যবধান। প্রকৃতপক্ষে২০১৯ সালের ৫ আগস্ট যখন ভারত বেআইনিভাবে কাশ্মীরকে বিভক্ত করে দেশটির ইউনিয়নে সংযুক্ত করেযা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের স্পষ্ট লঙ্ঘনতখন থেকেই সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। এর পর ভারত দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেযার জেরে পাকিস্তান বাণিজ্য স্থগিত করে এবং তার হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে। মোদি সরকারের ২০১৯ পরবর্তী কার্যক্রম পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলে।

ভারত চায়পাকিস্তান যেন ৫ আগস্ট২০১৯-এর পরিবর্তন মেনে নেয় এবং এটিকে ভবিষ্যৎ সংলাপের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। ভারত এ বিষয়ে কোনো নমনীয়তা দেখাতে রাজি নয়বরং তার কর্মকর্তারা বারবার বলেছেনকাশ্মীর সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে” এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার কিছু নেই। ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ঘোষণা করেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপের যুগ শেষ … কাশ্মীর প্রসঙ্গে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিলুপ্তি সম্পন্ন।” এই গ্রহণযোগ্য না-হলে-ত্যাগযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তানকে একটি নীতিগত সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করায়। পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব যতই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভাবুক না কেনতারা কাশ্মীর বিষয়ে তাদের নীতিগত অবস্থান ত্যাগ করতে পারে না। কাশ্মীর ইস্যুকে পাশে সরিয়ে রেখে বাণিজ্যসহ অন্যান্য সম্পর্ক পুনরায় শুরু করলে দিল্লি এটিকে ২০১৯ সালের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার পরোক্ষ স্বীকৃতি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই দ্বন্দ্বের সমাধান করাই বড় নীতিগত চ্যালেঞ্জ।

তবেবাস্তবিক কিছু বিষয়ে কাজের পর্যায়ে দুই দেশের কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ চলছে। এর ফলে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে করতারপুর করিডোর চুক্তি আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়যাতে ভারতের শিখ তীর্থযাত্রীরা পবিত্র স্থানটি পরিদর্শন করতে পারে। এটি দিল্লির অনুরোধে করা হয়। ধর্মীয় স্থান ভ্রমণের জন্য ভিসা প্রদান এবং একে অপরের জলসীমায় ঢুকে পড়া জেলেদের মুক্তি দেওয়াএগুলোও সহযোগিতার ক্ষেত্র।

এই নিম্নপর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগে বরফ গলবে না। সম্পর্কের এই জমে থাকা অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে উভয় দেশের নেতৃত্বকে সদিচ্ছা ও নমনীয়তা দেখাতে হবে। কিন্তু আপাততমনে হচ্ছে ভারতের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থানই তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। বিজেপি সরকার রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে সবসময় খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরে হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে আরও শক্তিশালী করছে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রযুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
 নিবন্ধটি ২৪ মার্চ ২০২৫ডন এ ছাপা হয়

ভা্রত- পাকিস্তান সম্পর্ক ইতিবাচক হবার সম্ভাবনা আরো ক্ষীন হলো

০৮:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

মালীহা লোধি

দুইটি সাম্প্রতিক ঘটনা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার উত্তপ্ত সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছেযা এই দুই দেশের সম্পর্কের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে আরও ক্ষীণ করে তুলেছে। প্রথম ঘটনা হলো বেলুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলা ও হাইজ্যাক এবং এরপর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বিবৃতি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি পডকাস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগযেখানে তিনি বলেনপাকিস্তান একটি প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে তার দেশের বিরুদ্ধে। এই কথার লড়াই নতুন কিছু নয়তবে এর পুনরাবৃত্তি দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক অচলাবস্থাকে আরও গভীর করে তুলেছে।

বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে বলেনভারতের পূর্ব দিকের প্রতিবেশী দেশ দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের সহিংসতা উসকে দিচ্ছে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এই অভিযোগগুলো ইসলামাবাদ বহুদিন ধরেই করে আসছে২০১৬ সালে আরডব্লিউএর কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদবের গ্রেপ্তারযিনি পাকিস্তানে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হনতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। তিনি স্বীকার করেন যে পাকিস্তানে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলিকে সহায়তা করতে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। ভারতের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং বলা হয় এই অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন” এবং পাকিস্তানকে নিজের ভেতরের দিকে তাকানো উচিত

লেক্স ফ্রিডম্যানের সঙ্গে একটি পডকাস্টেযা ১৬ মার্চ সম্প্রচারিত হয়প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ মন্তব্য করেনযা দুই দেশের মধ্যকার বিষাক্ত পরিবেশকে আরও বিষিয়ে তোলে। তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ এবং কথিত মিথ্যা শান্তি উদ্যোগকে দায়ী করেন। মোদির দাবিভারত শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলকিন্তু পাকিস্তান তা প্রতারায় পরিণত করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ গ্রহণ করেনি। তিনি পাকিস্তানকে অস্থিরতার কেন্দ্রস্থল” বলে অভিহিত করেন। এই ধরনের বক্তব্য নতুন নয়তবে এই সময় তা আরও উত্তেজনা তৈরি করেছে।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

প্রধানমন্ত্রী মোদির এই মন্তব্য আসলে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ভারতের তৈরি করা বর্ণনাকে আরও জোরালো করে তোলে। এতে সম্পর্কের অবনতির পুরো দায় পাকিস্তানের ওপর চাপানো হয় এবং স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করার দায়টিও তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এটি সেই কৌশলের অংশযার মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছেযা ভারতের অনেকের দৃষ্টিতে একটি দুর্বল মুহূর্ত। বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয় মিডিয়ায় যেভাবে অতিমাত্রায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছেতাতে মনে হয়েছে এটি পূর্বপরিকল্পিত প্রচার।

এই পরিস্থিতি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে একটি অনিশ্চিত ও অস্থির অবস্থানে নিয়ে এসেছে। গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আনুষ্ঠানিক সংলাপ বন্ধ রয়েছে। বর্তমান উত্তেজনার বিষয়বস্তুর প্রকৃতি বিবেচনায় নিলেএকটি ব্যাকচ্যানেল (গোপন সংলাপের পথ) কার্যকর হতে পারে যাতে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং ভুল হিসাব-নিকাশ এড়ানো যায়।

ইসলামাবাদ এমন একটি প্রক্রিয়া চালু করতে আগ্রহী এবং এটি অনানুষ্ঠানিকভাবে ট্র্যাক টু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানানো হয়েছেযেখানে দুই দেশের সাবেক কর্মকর্তাসহ অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মতবিনিময় হয়। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি ট্র্যাক টু বৈঠকে পাকিস্তানের ব্যাকচ্যানেল প্রস্তাবে ভারত সাড়া দেয়নি। বরং তারা বলেছেএই বিষয়টি জুলাইয়ে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন বা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) সাইডলাইনে দুই নেতার বৈঠকে আলোচনা হতে পারেযদি সেই বৈঠক হয়।

সরকারি পর্যায়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি হলোবর্তমানে বিদ্যমান ব্যবস্থাই যেকোনো সঙ্কট মোকাবিলা বা প্রতিরোধে যথেষ্ট এবং তাই আনুষ্ঠানিক ব্যাকচ্যানেল প্রয়োজন নেই। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় অতীতে উত্তেজনা বেড়ে গেলে রাওয়ালপিন্ডি ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে যেসব যোগাযোগ হয়েছে তা থেকে। এমন একটি ঘটনা ছিল ২০২২ সালের মার্চেযখন ভারত ভুলবশত একটি ব্রাহমোস ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তানের মিয়ান চান্নুতে নিক্ষেপ করে। সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল এবং বড় ধরনের সঙ্কট এড়ানো গিয়েছিল।

পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপ পুনরায় শুরু করার পথে একাধিক বাধা রয়েছে। সবচেয়ে বড় বাধা হলোঅধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে অমোচনীয় ব্যবধান। প্রকৃতপক্ষে২০১৯ সালের ৫ আগস্ট যখন ভারত বেআইনিভাবে কাশ্মীরকে বিভক্ত করে দেশটির ইউনিয়নে সংযুক্ত করেযা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের স্পষ্ট লঙ্ঘনতখন থেকেই সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। এর পর ভারত দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেযার জেরে পাকিস্তান বাণিজ্য স্থগিত করে এবং তার হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে। মোদি সরকারের ২০১৯ পরবর্তী কার্যক্রম পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলে।

ভারত চায়পাকিস্তান যেন ৫ আগস্ট২০১৯-এর পরিবর্তন মেনে নেয় এবং এটিকে ভবিষ্যৎ সংলাপের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। ভারত এ বিষয়ে কোনো নমনীয়তা দেখাতে রাজি নয়বরং তার কর্মকর্তারা বারবার বলেছেনকাশ্মীর সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে” এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার কিছু নেই। ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর ঘোষণা করেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপের যুগ শেষ … কাশ্মীর প্রসঙ্গে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিলুপ্তি সম্পন্ন।” এই গ্রহণযোগ্য না-হলে-ত্যাগযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি পাকিস্তানকে একটি নীতিগত সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করায়। পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব যতই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভাবুক না কেনতারা কাশ্মীর বিষয়ে তাদের নীতিগত অবস্থান ত্যাগ করতে পারে না। কাশ্মীর ইস্যুকে পাশে সরিয়ে রেখে বাণিজ্যসহ অন্যান্য সম্পর্ক পুনরায় শুরু করলে দিল্লি এটিকে ২০১৯ সালের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার পরোক্ষ স্বীকৃতি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই দ্বন্দ্বের সমাধান করাই বড় নীতিগত চ্যালেঞ্জ।

তবেবাস্তবিক কিছু বিষয়ে কাজের পর্যায়ে দুই দেশের কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ চলছে। এর ফলে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে করতারপুর করিডোর চুক্তি আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়যাতে ভারতের শিখ তীর্থযাত্রীরা পবিত্র স্থানটি পরিদর্শন করতে পারে। এটি দিল্লির অনুরোধে করা হয়। ধর্মীয় স্থান ভ্রমণের জন্য ভিসা প্রদান এবং একে অপরের জলসীমায় ঢুকে পড়া জেলেদের মুক্তি দেওয়াএগুলোও সহযোগিতার ক্ষেত্র।

এই নিম্নপর্যায়ের কূটনৈতিক যোগাযোগে বরফ গলবে না। সম্পর্কের এই জমে থাকা অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে উভয় দেশের নেতৃত্বকে সদিচ্ছা ও নমনীয়তা দেখাতে হবে। কিন্তু আপাততমনে হচ্ছে ভারতের নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থানই তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। বিজেপি সরকার রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে সবসময় খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরে হিন্দুত্ব এজেন্ডাকে আরও শক্তিশালী করছে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রযুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
 নিবন্ধটি ২৪ মার্চ ২০২৫ডন এ ছাপা হয়