লিটন রহমান
সকাল সকাল হকারের হাক, “ আলু চার কেজি একশ, পেয়াজ তিনকেজি একশ ’’ । শুনেই ভাবলাম ঈদের ছুটি শুরুর আগে এতো ভালো খবর , কিছু পেয়াজ-আলু কিনেই রাখা যায়, যদি হাতে টাকা থাকে। কিন্তু বোনাস তো হয়নি । বেতনের টাকায় কোনো রকমে পরিবারের ছোটদের ঈদের জামা কেনা গেলো। এখন তো কিনতে হবে সেমাই। আর ইদৈর দিনের জন্য অল্প হলেও পোলাওয়ের চাল আর কিছু গরুর মাংস । গনমাধ্যমের খবর দেখি বেড়েছে মুরগী আর গরুর মাংসের দাম । খাসীর মাংসতো অনেক আগেই নাগালের বাইরে। শুধু এই রমজান মাসে বোধ হয় একমাত্র ডিমের দামই কমে গেছে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নীচের স্তরে! শুধু ভাবাচ্ছে খামারীদের কথা তারা কি ডিমের উৎপাদন খরচ তুলে ডিম বিক্রী করতে পারছে ?
সেমাইয়ের দামের খোজ নেয়া হয়নি। চিনির দামে স্বস্থি আছে, তবে এক লিটারের মিল্কভিটা দুধের দাম দেখি ৯০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা চাইলো পাড়ার মুদির দোকানে। মিল্কভিটা কোম্পানি কি দাম বাড়িয়ে দিল ? তাইতো বলছে প্রথম আলো । পত্রিকার (২৮ মার্চ) শেষ পাতার শিরোনাম “ তরল ও গুড়া দুধের দাম বাড়তি ’’ । এই খবরে অবশ্য বলা হয়েছে “ঈদের আগে দাম বেড়েছে মিল্কভিটার তরল দুধের । গত সপ্তাহে মিল্ক ভিটার প্রতি লিটার দুধে ১০ টাকা দাম বাড়ানো হয়। খুচরো কোথাও কোথাও গুড়া দুধের দামও বাড়তি ’’ । খবর পড়ে জানা গেলো প্রাণ এবং আড়ংয়ের তরল দুধের দামও বেড়েছে আগের মাসেই। তবে কি সবাই মিলেই দুধের দাম বাড়ালো রোজা উপলক্ষে , একে কি সিন্ডিকেট বলা যাবে ?
প্রথম আলোতেই আরেকটি খবরের শিরোনাম “ বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ে চিঠি – ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৮ টাকা বাড়াতে চান ’’ । প্রশ্ন জাগে তাহলের মিল্কভিটার দুধের দাম বাড়ানোর চাপ দিল কে ? মিল্ক ভিটা তো সরকারের সমবায় । স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের পল্লী উন্নয়ন সমবায় বিভাগই তো এই সংস্থা দেখাশোনা করে । দুধের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে কি মন্ত্রনালয়ের সায় ছিল ?
রোজার আগে সরকার ভোজ্যতেলের ভ্যাট ও আমদানী শুল্কে ছাড় দিয়েছিল। কিন্তু দাম কমলেও ভোক্তারা নাকাল হয়েছিল এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন না পেয়ে । শুল্ক ছাড়ের কারনে দামী মেডজুল খেজুরও ১২০০/১৪০০ টাকা কেজিতে পাওয়া গেছে। তবে অল্প আয়ের মানুষেরা ২০০/৩০০ টাকার বড়ই খেজুরেই তৃপ্তমনে খেজুর খাওয়ার সাধ মিটিয়েছে। কোনো রকমে রোজার মাসের শেষ সপ্তাহে এসে এখন যদি দুধ আর মাংসের দাম বাড়ে তাহলে ঈদের দিনে সেমাই আর পোলাও মাংস কিভাবে জুটবে ? ডিমের ডজন অবশ্য ১২০ টাকাতেও নেমেছে, তবে কি এবার ডিমের কোরমায় সারতে হবে ঈদের আয়োজন ? আর ঈদের পরপরই যদি ভ্যাটের ছাড় প্রত্যাহার হয় তবে কি সত্যিই লিটারে ১৮ টাকা বেড়ে যাবে সয়াবিন তেলের দাম ? তেল ছাড়া রান্নার যে রেসিপি দেয় সাওয়াল হার্ট ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে ,আমরা কি সবাই সেটাই অনুসরন করবো ?
শুরুতেই বলেছিলাম প্রায় এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে বিক্রী হচ্ছে ডিমের দাম । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান বিজ্ঞাপন দেখছি কমদামে ডিম বিক্রীর। অনলাইন শপ চালডালের বিজ্ঞাপন “ আজ ডিম মাত্র ১১৫ টাকা ডজন, এটা আগের ১২৯ টাকার চেয়ে ডজনে ১৪ টাকা ছাড় । একদিনতো সেরামূল্য বলে ডজন ১০৫ টাকাও বলেছিল। জানিনা কতজন সেদিন অনলাইনে ‘জলের দামে ‘ ডিম কিনেছিল ? ফেসবুকে একদিন দেখলাম , তেজগাঁও ডিমের বাজার ঘোষণা দিয়েছে “ আজকের ডিমের বাজারে খামার রেট- লাল ৯ টাকা , সাদা ৮.৬০ পয়সা, পাইকারি কিনতে যোগাযোগ করুন’’ । ফেসবুকে জাকিয়া হোসেইন পোস্ট করেছেন “ পাচ বছর ধরে সংসারের বাজার করি। এই প্রথম ১০০ টাকায় ১ ডজন ডিম কিনছি ’’। প্রশ্ন ঈদের পরে কি এমন সস্তায় ডিম মিলবে ? যখন সবাই সকালে নাস্তা খেতে শুরু করবে ,পুরোদমে খুলবে ঢাকার সকল মধ্যবিত্তের হোটেল রেস্তোরা ?
রোজা তো শেষই হচ্ছে , ঈদের আনন্দ কি নতুন জামায় করতে পারবে গার্মেন্টেসের শ্রমিক পরিবারগুলো ?
৭৫০/৮০০ টাকার গরুর মাংস কিনতে যাদের কষ্ট হবে তাদের তো মুরগী কিনতেও বাড়তি দাম দিতে হবে । বাজারে বয়লার মুরগীর দাম কেজিতে ২০/৩০ টাকা বেড়ে গেছে। ঈদ বাজারে বেড়েছে পোষাকের দামও । সরকারি চাকুরেদের বাইরে অনেকেরই বোনাস হবে না। খোজ নিয়ে জানলাম অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানই বোনাস দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আর নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ যারা তাদেরতো মাস শেষে এমনই হাত খালি। কিভাবে হবে ঈদের কেনাকাটা?
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যে ভালো চলছে না তা বিতর্কের সুযোগ কম । যদিও প্রবাসীরদের পাঠানো রেমিট্যান্স উপচে পড়ে বিগত সময়ের তুলনায় রের্কড তৈরী হচ্ছে। কিন্তু যাদের ঈদের খরচে ডলার আসে না তারা কতটা উদযাপন করবে ঈদের আনন্দ ? তবুও ভীড় চোখে পড়ে ঈদের শপিংয়ে। সাধ আর সাধ্যের লড়াই চিরকালের। যিনি পরিবারের প্রধান বা একমাত্র আয়কারী,তিনি বোঝেন একটা ঈদ পাড়ি দেয়া কতটা ঝক্কির ? সে বড় পোষাক কারখানার মালিক, ছোট মুদি দোকানদার বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এমনকি বেসরকারী খাতের ছোট-মাঝারি চাকুরীজিবী যেই হোন না কেন । আর কারো না হোক পরিবারের শিশু আর বয়স্কদের জন্য একটা নতুন জামা বা ঈদের দিন একটু “ ভালো-মন্দ ’’খাবারের আয়োজন করার দুশ্চিন্ত তাদের আনন্দ কতটা উদযাপিত হয় ? তবুও ঈদের দিনের নামাজে সবাই পরম দয়ালু আল্লাহর উদ্দেশে, মোনাজাতে দেশ-জাতির আর নিজ পরিবারের সুখ-শান্তিই কামনা করে। খাবার পোলাও মাংস বা একটু ডিমের কোরমা হলেও,হাসিমুখে বলে ঈদ মুবারক ।