ভিক্টোরিয়া হিথ
আমরা যখন ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে ব্রিটিশ সামার টাইমে প্রবেশ করি, আলাস্টেয়ার বোনেট উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম উপকারী আবিষ্কার – টাইম জোন – এর ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছেন।
সময় কি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বহন করে? ইংলিশ চ্যানেল পেরোতে গিয়ে কেউ ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়েই বুঝতে পারবেন যে সূর্য যেন সব দেশের সকালকে ছুঁয়ে যায়, সেই চেষ্টারই অংশ এটি।
টাইম জোনের ধারণা উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে উদ্ভব হয়। আবর্তিত গ্রহে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের স্বার্থে এগুলো অপরিহার্য। তবে এতে মজার কিছু বিষয়ও রয়েছে। বিশ্ব মানচিত্রে সমুদ্রের উপর দিয়ে টাইম লাইন সাধারণত সোজা থাকে, কিন্তু স্থলভাগে ঢুকে এগুলো বিচিত্রভাবে বাঁক নেয়, যাতে প্রতিটি দেশ বা এলাকার মানুষ একই সময়-সীমায় থাকতে পারে।
প্রতিটি সীমানার মতো টাইম জোনেরও অদ্ভুত কিছু গল্প রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া দখল করে, তখন সেটিকে মস্কো সময়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সিম্ফেরোপোলের প্রধান রেলস্টেশনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাত ১০টা থেকে ঘড়ির কাঁটা একলাফে মধ্যরাতে নিয়ে যাওয়া হয়; কয়েক শ’ মানুষ রাশিয়ার পতাকা নেড়ে “ক্রিমিয়া! রাশিয়া!” বলে স্লোগান দেয়। এখন ক্রিমিয়া ইউক্রেনের সময়ের থেকে দুই ঘণ্টা এগিয়ে, এবং ইউক্রেনের দখলীকৃত অন্যান্য এলাকাও একই সময় অনুসরণ করছে। এভাবে সময় পাল্টে শাসকগোষ্ঠী তাদের আনুগত্য ও বিভেদের বার্তা দেয়। স্থানীয়দের দৈনন্দিন ছন্দও বদলে যায়; ক্রিমিয়ানরা এখন মস্কোবাসীর সঙ্গে একই সময়ে জাগে ও ঘুমায়।

স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা প্রায়ই ঘড়ির কাঁটায় কারসাজি করতে পছন্দ করে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া “পিয়ংইয়ং টাইম” চালু করেছিল, যা দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে আধা ঘণ্টা পিছিয়ে ছিল। সরকারি বার্তায় বলা হয়েছিল, জাপানি সাম্রাজ্যবাদীদের চাপিয়ে দেওয়া টাইম জোন থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে এটি চালু করা হয়েছে। তবে এটি দুই কোরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করার বড় আকাঙ্ক্ষার বিপরীত দিকে কাজ করছিল, তাই বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
আরেকটি আধা ঘণ্টার সময়ের অদ্ভুততা ছিল ভেনেজুয়েলায়, ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত। সেখানেও ঘড়ি আধা ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বে কয়েকটি দেশেই মাত্র এমন ভগ্নাংশের টাইম জোন আছে – ভারতের (+৫.৩০) ও ইরানের (+৩.৩০) মতো। ভেনেজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ জানিয়েছিলেন, মানুষের জন্য “সূর্যোদয়ের সময়ের সুষ্ঠু বণ্টন” করার উদ্দেশ্যে এটি করা হয়েছে। পরে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এটি বাতিল করেন কারণ সন্ধ্যায় বিদ্যুতের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দেশের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠছিল।
এ রকম পরিবর্তনগুলো আমাদের কৌতূহলী করে তোলে, কারণ এগুলো সাম্প্রতিক বা বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদের নজর কেড়েছে। কিন্তু এমন কিছু অদ্ভুত সিদ্ধান্ত রয়ে গেছে, যা এখন আর আমাদের নজরে আসে না। কখনও কি ভেবেছেন, পর্তুগালের মতো একই দ্রাঘিমায় থাকার পরও কেন স্পেন গ্রিনিচ মান সময় (ইউটিসি/জিএমটি) থেকে এক ঘণ্টা এগিয়ে? ভূখণ্ডের অধিকাংশই লন্ডনের পশ্চিমে অবস্থিত, কারণ উত্তর-পূর্ব স্পেন অতিক্রম করে প্রধান মেরিডিয়ান সমুদ্রে চলে গেছে। ১৯০০ সাল পর্যন্ত স্পেনে সময় ছিল ইউটিসি/জিএমটি। তার আগে বিশ্বের অন্য বহু অঞ্চলের মতোই বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলে সূর্য অবস্থান অনুযায়ী নিজস্ব স্থানীয় সময় বজায় রাখা হতো।
![]()
কিন্তু কীভাবে সেই সময় এক ঘণ্টা এগিয়ে গেল? স্বাভাবিকভাবেই, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের শেষের দিকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরা নাৎসি জার্মানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও মিত্রতার প্রতীক হিসেবে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে ১৯৪০ সালে এটি জাতীয় নীতিতে পরিণত হয় এবং সেখানেই রয়ে গেছে; এর পিছনে থাকা ঐতিহাসিক কারণ ভুলে গিয়ে এখন কেবল এটাই দেখা হয় যে এর মাধ্যমে ফ্রান্স ও পশ্চিম ইউরোপের সময়ের সঙ্গে মিল রয়েছে।
এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্নও ওঠে – কোন দেশের সবচেয়ে বেশি টাইম জোন আছে? এর উত্তর ফ্রান্স, কারণ এর সুদূরপ্রসারী বৈদেশিক অঞ্চলসহ মোট ১২টি টাইম জোন রয়েছে। তবে এটি পরোক্ষভাবে বিবেচিত; একই যুক্তিতে যুক্তরাজ্যেরও নয়টি টাইম জোন ধরা যেতে পারে। বাস্তবসম্মত ও সরাসরি উত্তরটি হলো রাশিয়া – এর মূলভূখণ্ডে ১০টি টাইম জোন, সাথে কালিনিনগ্রাদকে ধরলে ১১টি।
সবচেয়ে অদ্ভুত টাইম জোন সম্ভবত চীনের, অন্তত যেসব মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেই সংখ্যার দিক থেকে। প্রস্থে চীন মহাদেশীয় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড়, যেখানে চারটি টাইম জোন আছে। অথচ চীনে মাত্র একটি টাইম জোন। ১৯১২ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সেখানে পাঁচটি টাইম জোন ছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় আসা কমিউনিস্ট সরকার জাতীয় সংহতির লক্ষ্যে “এক দেশ, এক সময়” নীতি গ্রহণ করে। বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বেশ অদ্ভুত।
টাইম জোনের মূল উদ্দেশ্য মানুষের ভাগ হওয়া নয়, বরং সবাই যেন সূর্যোদয়ের সময়ের কাছাকাছি সকালের কাজ শুরু করতে পারে, সেটাই নিশ্চিত করা। কিন্তু চীনে ১৯৪৯ সাল থেকে তা হয় না। সারা দেশের সময় “বেইজিং টাইম” নির্ধারিত। এতে পশ্চিমাঞ্চলে সকালগুলো বেশ অন্ধকারে কাটে। কার্যত, সেখানকার মানুষ সবকিছু দেরিতে করে। “মধ্যাহ্নভোজ” নামেই রয়ে গেছে, কিন্তু বেইজিং টাইম অনুসারে সেটি বেলা ২টা বা ৩টায় হয়।

চীনের সবচেয়ে পশ্চিম প্রদেশ জিনজিয়াং-এ “এক চীন, এক সময়” নীতির রয়েছে জাতিগত মাত্রা। এখানে স্থানীয় উইঘুর ও হান চীনা সম্প্রদায় যুগপৎ বাস করলেও সময় বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। সিনোলজিস্ট এনজে হান উল্লেখ করেছেন, পশ্চিমাঞ্চলে হানরা কোনোভাবেই বেইজিং সময় ছেড়ে যেতে চায় না, যদিও এতে নানা অসুবিধা হয়। তাদের মতে এটি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক, আর উইঘুরদের থেকে নিজেদের পৃথক রাখার উপায়। এনজে হানের একজন সাক্ষাৎদাতা বলেছেন, “আমাদের নিজেদের সময় আছে, তাদের আছে তাদের সময়, আমরা কেউ একে অন্যের সঙ্গে মেশিনে না।”
টাইম জোনের এই গোটা ধারণা প্রথম বিশ্বব্যাপী প্রস্তাব করেন স্কটিশ-কানাডীয় প্রকৌশলী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী স্যানফোর্ড ফ্লেমিং। ১৮৭৬ সালে তিনি প্রস্তাব করেন যে পৃথিবীকে ২৪টি অঞ্চলে ভাগ করা হোক, প্রতিটি ১৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমার পরিসরে। পরের কয়েক দশকের মধ্যে তার ধারণা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায় এবং আধুনিক জীবনের ভিত্তিমূলের এক হয়ে ওঠে।কোনো ব্যবস্থাই যে সীমান্ত তৈরি করে না, তা নয়। নতুন টাইম জোন ব্যবস্থায় অবশ্যই একটা “সীমারেখা” বা বিভাজ থাকে, যেখানে “গতকাল” আর “আগামীকাল” পাশাপাশি অবস্থান করে।
এর সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ হলো বিয়ারিং প্রণালি, যেখানে বরফাচ্ছন্ন জলরাশি আলাস্কা ও চুকচি উপদ্বীপকে আলাদা করে। এখানে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। রাশিয়ার বিগ ডায়োমিড ও যুক্তরাষ্ট্রের লিটল ডায়োমিড দ্বীপদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব মাত্র ৩.৮ কিলোমিটার। এই দুটি দ্বীপকে “গতকাল” ও “আগামীকাল” বলেও ডাকা হয়, কারণ আন্তর্জাতিক তারিখরেখা এদের মধ্য দিয়েই গিয়েছে। কেউ যদি রাশিয়ান দ্বীপ থেকে আমেরিকান দ্বীপে যায়, তারা পুরো এক দিনের ব্যবধানে লাফ দেবে: মঙ্গলবার ভোরে রওনা হয়ে সঙ্গে সঙ্গে সোমবার সকালে পৌঁছে যাওয়ার মতোই ব্যাপার।
টাইম জোন, এক্ষেত্রে, যেন বাস্তবের সময় ভ্রমণের স্বাদ এনে দেয়।
Sarakhon Report 



















