সারাক্ষণ রিপোর্ট
ট্রাম্পের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিপ্লব
“এটি একটি অর্থনৈতিক বিপ্লব, এবং আমরা জয়ী হব”—এই বক্তব্য শুধু বাণিজ্যনীতির ঘোষণা নয়, বরং ট্রাম্পের বৃহত্তর লক্ষ্য—আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে নতুনভাবে সাজানো। তার লক্ষ্য মূলত আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যেগুলো আমেরিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে। তবে এই রূপান্তর উচ্চশিক্ষা, উদ্ভাবন ও স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিরপেক্ষতা হারানো
গত দশকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দুই দলের সমর্থন হারিয়েছে। ‘নিরাপত্তা’ ও ‘সংবেদনশীলতা’র নামে বিতর্কিত বক্তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাজনীতিতেও বিভাজন স্পষ্ট হয়েছে—যেখানে ডিগ্রিধারী নাগরিকদের বড় অংশ ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকেছে, বিশেষত ২০২৪ সালের নির্বাচনে।
রক্ষণশীলদের অবস্থান বদল
আগে রক্ষণশীলরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উগ্র’ মতাদর্শের সমালোচক হলেও, তারা গবেষণার স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিত। সরকারি অনুদানের বদলে স্বাধীন চিন্তা—এই ভারসাম্য থেকেই ইন্টারনেট ও পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটরের মতো উদ্ভাবন হয়েছে। কিন্তু এখন সেই ভারসাম্য ভাঙার চেষ্টা চলছে।
প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা
বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের সহাবস্থানেই জন্ম হয়েছে MRNA ভ্যাকসিন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং আধুনিক কম্পিউটিংয়ের মতো আবিষ্কার। এসবই আমেরিকাকে বৈশ্বিক মেধার কেন্দ্র করে তুলেছে। কিন্তু ট্রাম্পের নতুন পদক্ষেপগুলো এই অবকাঠামোকে ধ্বংস করতে পারে।
প্রতিশোধ ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমালোচনার জবাবে ট্রাম্প প্রশাসন অনুদান বন্ধ করেছে। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে বক্তব্য রাখায় কিছু বিদেশি শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। করও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেমন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সিনেটর জেডি ভ্যান্স বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের ওপর ৩৫% কর প্রস্তাব করেছেন।
মতপ্রকাশে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ
সরকার কখনো বলে তারা ‘উইক চিন্তা’র বিরুদ্ধে, আবার কখনো ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ ঠেকানোর কথা বলে। কিন্তু লক্ষ্য একটাই—প্রতিপক্ষের মত চাপা দেওয়া। একদিকে ‘ক্যানসেল কালচার’ বিরোধিতা, অন্যদিকে ভিন্নমতের ছাত্রদের দমন—এই দ্বৈতনীতি স্পষ্ট।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীরব আত্মসমর্পণ
হার্ভার্ড ও কলাম্বিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া এসেছে নীরব আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এক বছরে তিনজন প্রেসিডেন্ট বদলেছে, হার্ভার্ড বিভাগীয় নেতৃত্ব বদলেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপে সংকট প্রশমিত হয়নি, বরং রিপাবলিকানদের মধ্যে আরও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে তারা সহজেই এই প্রতিষ্ঠানগুলো দমন করতে পারবে।
বিশাল বাজেটেও অনিশ্চয়তা
হার্ভার্ডের বার্ষিক অনুদান ১ বিলিয়নের বেশি, কিন্তু ৩৫% কর বসলে এই তহবিল দ্রুত হ্রাস পাবে। কলাম্বিয়ার ৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেটের ১.৩ বিলিয়ন আসে সরকার থেকে। যেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন তহবিলের সুবিধাও পায় না, সেখানে আইভি লিগগুলোও যদি টিকতে না পারে, বাকিদের পরিণতি কল্পনাতীত।
সঠিক পথে ফিরতে কিছু সংস্কার জরুরি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষায় স্পষ্ট নীতি গ্রহণ, প্রশাসনিক ব্যয় কমানো, নিয়োগে রাজনৈতিক বিবৃতি বন্ধ করা, মতাদর্শিক বৈচিত্র্য বাড়ানো। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: গবেষণা ও শিক্ষার বিষয়বস্তু বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরাই নির্ধারণ করবে—সরকার নয়।
স্বাধীনতার ভিত্তি স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়
গত ৭০ বছর আমেরিকাকে উদ্ভাবনের শীর্ষে রেখেছে এই নীতিই। যেখানে রাশিয়া বা চীন ব্যর্থ, আমেরিকা সফল হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার উদারতায়। প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার ১৯৬১ সালে বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন—“স্বাধীন চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল উৎস হচ্ছে স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়।”
একসময়ের আশঙ্কা আজ বাস্তব
আইজেনহাওয়ারের হুঁশিয়ারি ছিল—যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে, তাহলে সরকারই তাদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন এটি অতিরঞ্জিত মনে হলেও, আজ ট্রাম্পের প্রশাসনে তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে—যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।