সারাক্ষণ রিপোর্ট
সেলুলয়েডের আবিষ্কার এবং প্লাস্টিকের উত্থান
১৮৫৮ সালে বিখ্যাত বিলিয়র্ড খেলোয়াড় মাইকেল ফেলান যখন হাতির দাঁতের বদলে বিকল্প উপকরণ খুঁজে বের করার আহ্বান জানান, তখন জন হায়্যাট পাঁচ বছর পর প্রথম সফল সিন্থেটিক প্লাস্টিক “সেলুলয়েড” উদ্ভাবন করেন। যদিও তিনি প্রতিদানের ১০,০০০ ডলার পাননি, তবু এখান থেকেই প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহারের যুগ শুরু হয়।
মনোমারের পুনরাবৃত্তি: প্লাস্টিকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
প্লাস্টিকের মৌলিক গঠন হচ্ছে একাধিক মনোমারের সংযুক্তি, যা পলিমারে পরিণত হয়। এই গঠন প্লাস্টিককে হালকা, মজবুত, সস্তা এবং সহজে উৎপাদনযোগ্য করে তোলে, যা যেকোনো ধরনের পণ্য তৈরি করতে অনুকূল।

উৎপাদন ও বাণিজ্যে বিস্তার
২০০০ সালে বিশ্বে বার্ষিক প্রায় ২৩৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক তৈরি হতো। কিন্তু ২০২১ সালে তা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাস্টিক শিল্পের বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়।
হালকা ও কার্যকর প্যাকেজিং
এক লিটার প্লাস্টিক বোতলের ওজন কাচের বোতলের মাত্র ৫% এবং কাগজের ব্যাগের তুলনায় প্রায় ছয়গুণ কম। গ্লাস বা ক্যান ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্বন নির্গমন প্লাস্টিকের তুলনায় দ্বিগুণ থেকে ত্রিগুণ বেশি হওয়ায়, প্লাস্টিক দূরপথে পণ্য পরিবহন ও সংরক্ষণে সর্বোত্তম।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের অবদান
- নির্মাণে: পিভিসি পাইপ ও ইনসুলেশনে মজবুততা ও সাশ্রয় নিয়ে এসেছে
- ইলেকট্রনিক্সে: মোবাইল, ল্যাপটপ ও ফাইবার-অপটিক ক্যাবলের হালকা এবং টেকসই কেসিং নিশ্চিত করেছে
- স্বাস্থ্যসেবায়: একবার ব্যবহারযোগ্য সিরিঞ্জ, গ্লাভস ও মাস্ক সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে

পরিবেশগত খরচ: উৎপাদন থেকে নির্গমন
ফসিল ফুয়েল থেকে এথিলিন ও প্রোপিলিনের মতো হাইড্রোকার্বন উত্তোলন ও রিফাইনারিতে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড মুক্ত হয়। ফলত, বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন ও নিষ্পত্তি মোট গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৩.৪% দায়ী, যা বিমান চলাচলের চেয়ে বেশি।
প্লাস্টিক বর্জ্য: সংগ্রহ ও নিষ্পত্তি
প্রতি বছর তৈরি হয় প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য; এর ফলে প্রায় অর্ধেক ভরে যায় ল্যান্ডফিলে। সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে রাসায়নিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটি ও পানিতে মিশে, অথবা মিথেনের আকারে বাষ্পীভূত হয়ে পরিবেশকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পুনর্ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ
প্যাকেজিং প্লাস্টিকের ৯৫% একবার ব্যবহারেই ফেলে দেওয়া হয়, তন্মধ্যে মাত্র এক-চতুর্থাংশই সংগ্রহ করা হয়। বিভিন্ন রং বা অ্যাডডিটিভযুক্ত প্লাস্টিক মিশালে সারা ব্যাচই পুনর্ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বারবার রিসাইকেলে কাঠামোগত দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, ফলে দুই-তিনবার পর তা আর কাজে লাগে না।

মাইক্রোপ্লাস্টিকের স্বাস্থ্যজনিত উদ্বেগ
প্লাস্টিক ভাঙনের ফলে তৈরি হয় ক্ষুদ্র মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণিকা, যা খাদ্য ও পানিতে মিশে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। যদিও এর পূর্ণ প্রভাব এখনো অনিশ্চিত, তবে গবেষণা বলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা নানা দীর্ঘমেয়াদী অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়।
বর্জ্য রপ্তানি ও মানবাধিকার
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও তুরস্কের মতো দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবের ফলে বাধ্য হয়ে প্লাস্টিকের বর্জ্য বন্দরে জমতে থাকে, অবৈধভাবে পুড়িয়ে অথবা ফেলে দিয়ে পরিবেশ ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যে বিপদ ডেকে আনে। জাতিসংঘের হিসেব আছে প্রায় ২০ মিলিয়ন অনানুষ্ঠানিক শ্রমিক এ কাজ করে, যারা প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ পথ
২০২২ সালে সমুদ্র থেকে উৎস পর্যন্ত প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে ১৭৫ দেশ আলোচনায় নেমেছিল, কিন্তু তেল-নির্ভর দেশ ও কোম্পানি উৎপাদন কমাতে রাজি নয়, আর দরিদ্র দেশ ধনী দেশকে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে। তবুও উদ্যোগ হিসেবে পুনর্ব্যবহার বাড়ানো, সুরক্ষিত ল্যান্ডফিল ব্যবস্থা এবং বর্জ্য থেকে কার্বন ক্যাপচার করে শক্তি উৎপাদন করার মতো পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
বাস্তবিক হিসেব করলে, কাচের জার বা কাগজের ব্যাগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টায় হলেও,সামগ্রিক অর্থ-পরিবেশ সমন্বয় বিবেচনায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আগামীদিনেও অব্যাহত থাকবে।
Sarakhon Report 



















