সারাক্ষণ রিপোর্ট
বাংলাদেশ সরকার মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে সংশোধন এনেছে; কিডনি দাতা-গ্রহীতা “সোয়াপ” (বিনিময়) পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একইসঙ্গে ভাতিজা-ভাতিজি ও ভাগ্নে-ভাগ্নিকেও বৈধ দাতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই পরিপ্রেক্ষতিতে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পরিবর্তন, বিশ্বজুড়ে কিডনি রোগের প্রকোপ, চিকিৎসা-ব্যয় এবং রোগটির মারাত্মকতা বাস্তবে ভয়াবহ।
আইনি সংশোধন ও “কিডনি সোয়াপ” পদ্ধতি
- বর্তমান মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপন (সংশোধন) আইন ২০১৮-তে ২২ ধরনের নিকটাত্মীয় কিডনি দাতা হতে পারেন;এতে ভাতিজা-ভাগ্নেদের নাম নেই।
• ২৩ মার্চের বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ভাতিজা-ভাগ্নি যোগ ও অসঙ্গতিতে “সোয়াপ” অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
• “সোয়াপ” হলে দুই জোড়া দাতা-গ্রহীতা একই দিনে, একই হাসপাতালে কিডনি আদান-প্রদান করবেন—দাতার সাথে গ্রহীতার রক্ত-উত্তেজনাপ্রতিক্রিয়া মিল না থাকলেও মিলযুক্ত অন্য জুটির সাথে বিনিময় করে উভয়েই উপকৃত হবেন।
বিশ্বে কিডনি রোগের বিস্তার
- বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ (CKD)-এ ভুগছেন,যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ।
• কিডনি রোগ থেকে বছরে ৫–১১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হতে পারে; ২০০০–২০১৯ মধ্যে মৃত্যুহার ৫০% বেড়েছে।
• বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে কিডনি রোগ ছিল বিশ্বের নবম বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ।
বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা-ব্যয়
দেশ/অঞ্চল | হেমোডায়ালিসের বার্ষিক গড় ব্যয় | কিডনি প্রতিস্থাপনের মোট ব্যয় | সূত্র |
যুক্তরাষ্ট্র | ৪০–১০২ হাজার মার্কিন ডলার | ২.৩–৪.৪ লক্ষ ডলার | |
যুক্তরাজ্য | ডায়ালিস বছরে প্রায় £৩০,৮০০; প্রতিস্থাপন শল্যচিকিৎসা £১৭,০০০ এবং বাৎসরিক ওষুধ £৫,০০০ | — | |
ভারত | প্রতি সেশন ₹১,৫০০–৪,০০০; বছরে ₹২.১৬–৪.৮ লক্ষ | ₹৫–১৫ লক্ষ (প্রায় ৬–১৮ হাজার ডলার) | |
বাংলাদেশ | প্রতি সেশন গড় টাকা ১,৬০০; মাসিক গড় টাকা ৪৬,৪২৬ (সর্বনিম্ন টাকা ৬,৬৯০; সর্বোচ্চ টাকা ২,১০,০০০) | টাকা ৩–৫ লক্ষ (সরকারি/বেসরকারি); বিএসএমএমইউ-এ টাকা ৩ লক্ষ | |
অন্যান্য | ইউরোপে প্রতিস্থাপন গড় €৫০,০০০; বিশ্ববাজারে ডায়ালিস খাতের আর্থিক পরিমাণ ২০২৪-এ ৯৬.৪ বিলিয়ন ডলার | — |
বাংলাদেশে রোগ-চিত্র ও চিকিৎসা সংকট
- প্রায় ৩৮.২ মিলিয়ন বাংলাদেশি নানা ধরনের কিডনি রোগে আক্রান্ত;বছরে ৩০–৪০ হাজার কিডনি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
• বার্ষিক প্রয়োজনীয় কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ৫,০০০ হলেও সম্পাদিত হয় মাত্র ৪০০টি; ফলে প্রতি বছর ১৭,০০০’র বেশি মৃত্যু ঘটে।
• নতুন সংশোধন “সোয়াপ” চালু করলে দাতার সংকট খানিকটা লাঘব হতে পারে, কিন্তু অবকাঠামো, ক্যাডাভেরিক (মৃতদেহ) দানের স্বল্পতা ও ব্যয়ভার রয়ে যায়।
কেন কিডনি রোগ এত মারাত্মক
- CKDপ্রায় নিঃশব্দে বাড়তে থাকে;উপসর্গ দেখা দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেরি হয়ে যায়।
• ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, অনিয়ন্ত্রিত ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবহার এবং দূষিত পানি-খাদ্য বড় ঝুঁকি-কারক।
• একবার চূড়ান্ত পর্যায়ে (ESRD) পৌঁছালে নিয়মিত ডায়ালিস বা প্রতিস্থাপন ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব—উভয়ই ব্যয়বহুল ও জটিল।
• নিম্ন-মধ্য-আয়ের দেশগুলোয় স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা দুর্বল, ফলে পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক টানাপড়েন তীব্র হয়; বাংলাদেশে ৯২ শতাংশ পরিবারই ডায়ালিস ব্যয় মেটাতে গিয়ে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
- দেশের বেসরকারি সংস্থা ক্যাম্পসের সভাপতির মতে,দাতার সংকটই প্রধান প্রতিবন্ধক; আইন বদলে ইচ্ছুক দাতাকে সুযোগ দিলে এবং কেন্দ্রীয় ডাটাবেসের মাধ্যমে প্রতারক ঝুঁকি কমালে পরিস্থিতি উন্নত হবে।
• আন্তর্জাতিকভাবে, ২০৪০ সালের মধ্যে কিডনি রোগ “বছর-নষ্ট সূচকে” পঞ্চম প্রধান কারণ হতে পারে বলে পূর্বাভাস; উন্নত দেশগুলোয় বর্জ্য-প্রক্রিয়া ও প্রাথমিক স্ক্রিনিং জোরদার করায় মৃত্যুহার কমছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোয় দ্রুত বাড়ছে।
উপসংহার
- আইনি সংশোধন এবং“কিডনি সোয়াপ” অনুমোদন বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের নতুন দ্বার খুলতে পারে; সফল বাস্তবায়নে স্বচ্ছ ডাটাবেস, একই দিনে যুগ্ম শল্যচিকিৎসা ও কঠোর তদারকি জরুরি।
• বিশ্বজুড়ে কিডনি রোগের আর্থসামাজিক বোঝা দ্রুত বাড়ছে; মোট মৃত্যুর বড় অংশের জন্য দায়ী হলেও সচেতনতা ও বিনিয়োগ তুলনায় কম।
• প্রতিস্থাপন ডায়ালিসের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয়ী ও জীবনমানবান্ধব; তাই দাতার যোগান, ক্যাডাভেরিক দান এবং প্রযুক্তিনির্ভর স্ক্রিনিং বাড়াতে সমন্বিত আন্তর্জাতিক প্রয়াস প্রয়োজন।