সম্মেলনের সারাংশ: কার্বনের অন্যায় ও অভিযোজনের ন্যায্যতা
সাভারের ব্র্যাক সিডিএম-এ ২৫ ও ২৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হলো দুই দিনব্যাপী অষ্টম ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম (FIF) ২০২৫। সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকায় জলবায়ু অভিযোজন’। এতে অংশ নেন দেশি-বিদেশি ২০০ জনেরও বেশি বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা ও উন্নয়নকর্মী।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আমরা উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের শিকার, অথচ তাদের সহায়তা আসে ঋণের আকারে—এটি দ্বিগুণ অবিচার।” তিনি বলেন, অভিযোজন ও কার্বন হ্রাসের উদ্যোগ একসঙ্গে চলা জরুরি এবং প্রকৃতি-নির্ভর অভিযোজন বলতে নদী, খাল, বন ও কৃষিজমি রক্ষাকে, বোঝাতে হবে।
প্রথম দিনের আলোচনার দিকনির্দেশনা
প্রথম দিনে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। অনলাইনে যুক্ত হয়ে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’-এর মহাসচিব এবং মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

‘সহনশীলতার’ পক্ষে নীতিগত সহায়তার আহ্বান
সমাপনী দিনে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “সরকারকে ব্র্যাকের মতো সংস্থাকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের সঙ্গে কার্যকর অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।” তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিপর্যয়ের মধ্যেও সহনশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে—এখন সেই সহনশীলতাকে কার্যকর নীতির মাধ্যমে সমর্থন করা জরুরি।
উদ্ভাবন এখন বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন
ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় উদ্ভাবন এখন আর বিলাসিতা নয়, এটি প্রয়োজন। স্থানীয় অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ভরযোগ্য সমাধান তৈরি করা দরকার।” তিনি বলেন, স্বল্প ব্যয়ের উদ্ভাবন কেবল কারিগরি প্রচেষ্টা নয়, এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্বও।
প্রান্তিক মানুষের জ্ঞানই উদ্ভাবনের উৎস
ব্র্যাক গ্লোবাল-এর নির্বাহী পরিচালক জেরোম ওবেরিয়ে বলেন, “ফ্রুগাল ইনোভেশন মানে বিলাসবহুল প্রযুক্তি নয়। এটি গড়ে ওঠে প্রান্তিক মানুষের টিকে থাকার প্রয়োজনে।” তিনি জ্ঞান আহরণের অধিকারকে খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক চাহিদার সঙ্গে তুলনা করেন এবং বলেন, “জ্ঞান ও তথ্যের অভাবে জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়বে।”

ভারসাম্যহীন পৃথিবীতে নতুন উদ্যোগের প্রতিফলন
বিশিষ্ট প্রবাসী বিজ্ঞানী ও জেনোফ্যাক্স লাইফ সায়েন্সেসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. আবেদ চৌধুরী বলেন, “আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি যেখানে দূষণ সীমাহীন। ব্র্যাকের এই ফোরাম একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা।” তিনি ভবিষ্যতে ব্র্যাকের সঙ্গে যৌথভাবে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
দ্বিতীয় দিনের সেশনগুলো
দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সেশন হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ‘ক্রিয়েটিং অ্যান এনাবলিং এনভায়রনমেন্ট’ (সঞ্চালনা: মৌটুসী কবীর)
• ‘ফ্রুগাল ইনোভেশন ফর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট এগ্রিকালচার’ (সঞ্চালনা: ক্রিস্টিনা চ্যান)
• ‘কমিউনিটি ইন দ্য ড্রাইভিং সীট’ (সঞ্চালনা: হোসেন ইশরাত আদিব)
• ‘হোয়াট নিডস টু বি ইন দ্য সলিউশন বাস্কেট ফর ফার্মারস’ (সঞ্চালনা: অ্যাশলি টুম্বস)
• ‘ফাইন্যান্সিয়াল প্রডাক্টস অ্যান্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইন্স্যুরেন্স’ (সঞ্চালনা: কুলদীপ বন্ধু আরিয়াল)
এই সেশনগুলোতে জলবায়ু সহনশীল কৃষি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা, কৃষিতে প্রযুক্তি ও অর্থায়ন, জলবায়ু ঝুঁকি বিমা এবং অভিযোজনযোগ্য বীজ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

প্রদর্শনীতে বাস্তবভিত্তিক উদ্ভাবন
সাজিদা ফাউন্ডেশন, উইগ্রো এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনের মতো সংস্থাগুলো তাদের উদ্ভাবন উপস্থাপন করে। এসব উদ্যোগ দেখায় কীভাবে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন প্রান্তিক কৃষকদের ফসল হ্রাস, আবহাওয়া অনিশ্চয়তা ও অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করছে।
ফোরামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বার্তা
২০১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম গ্লোবাল সাউথের উদ্ভাবন ও সমাধান নিয়ে কাজ করছে। অতীতে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবারের ফোরাম বিশেষ বার্তা দিয়েছে—জলবায়ু অভিযোজনের কাজ কেবল জনগণের জন্য নয়, তাদের নিয়েই করতে হবে এবং তা শুরু হতে হবে তৃণমূল থেকে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















