১১:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৩)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ মে ২০২৫
  • 36
নজরুল
কিন্তু এসব উপদেশ আমার কানে প্রবেশ করিল না। এইভাবে প্রতিদিন সকালে উঠিয়া খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে ছুটিতাম। রাস্তায় দাঁড়াইয়া কাগজে বর্ণিত খবরগুলি উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করিতাম। মাঝে মাঝে কাগজের সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতাম। কলিকাতা শহরে কৌতূহলী লোকের অভাব নাই। তাহারা ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আমার বক্তৃতা শুনিত। কিন্তু কাগজ কিনিত না।
কাগজ বিক্রয় করিতে করিতে কার্তিকদাদার সঙ্গে পরিচয় হইল। বিক্রমপুরের কোন গ্রামে তাঁহার বাড়ি। তিনিও খবরের কাগজ বিক্রয় করিতেন। কিভাবে তাঁহার সঙ্গে আলাপ হইল, আজ সমস্ত মনে নাই। তবে এইটুকু মনে আছে, আমার অবিক্রীত কাগজগুলি কার্তিকদাদা বিক্রয় করিয়া দিতেন। আমারই মতো অনেক হকারের এটা-ওটা কাজ তিনি করিয়া দিতেন। সেইজন্য আমরা সকলে তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করিতাম।
আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে কার্তিকদাদা থাকিতেন। আমার বোনের বাড়িতে থাকার অসুবিধার কথা শুনিয়া কার্তিকদাদা আমাকে তাঁহার বাসায় উঠিয়া আসিতে বলিলেন। আট আনায় একটি মাদুর কিনিয়া লইয়া কার্তিকদাদার বাসায় উপস্থিত হইলাম। এক ভাঙা বাড়ির দ্বিতল কক্ষ কার্তিকদাদা ভাড়া লইয়াছিলেন। কক্ষটির সামনে প্রকাণ্ড খোলা ছাদ ছিল। সেই ছাদেই আমরা অধিকাংশ সময় যাপন করিতাম। বৃষ্টি হইলে সকলে ছাদ হইতে মাদুর গুটাইয়া আনিয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় লইতাম।
সকালে যে যার মতো খবরের কাগজ লইয়া বিক্রয় করিতে বাহির হইতাম। দেড়টা বাজিলে সকলে বাসায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর দুইটা তিনটার মধ্যে রান্না ও খাওয়া শেষ করিয়া তাড়াতাড়ি ছুটিয়া যাইতাম খবরের-কাগজের অফিসে। তখনকার দিনে বাংলা কাগজগুলি বিকালে বাহির হইত। রাত আটটা/নয়টা পর্যন্ত কাগজ বিক্রয় করিয়া বাসায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর রান্না-খাওয়াটা কোনো রকমে সারিয়া ছাদের উপর মাদুর বিছাইয়া তাহার উপর শ্রান্ত ক্লান্ত দেহটা ঢালিয়া দিতাম। আকাশে তারাগুলি মিটিমিটি করিয়া জ্বলিত। তাহাদের দিকে চাহিতে চাহিতে আমরা ঘুমাইয়া পড়িতাম। আকাশের তারাগুলি আমাদের দিকে চাহিয়া দেখিত কিনা কে জানে!
কোনো কোনো রাত্রে মোমবাতি জ্বালাইয়া কার্তিকদাদা আমার কবিতাগুলি সকলকে পড়িয়া শুনাইতেন। আমার সেই বয়সের কবিতায় কতটা মাধুর্য ছিল, আজ বলিতে পারিব না। সেই খাতাখানা হারাইয়া গিয়াছে। আর শ্রোতারা সেই সব কবিতার রস কতটা উপলব্ধি করিত, তাহাও আমার ভালো করিয়া মনে নাই। কিন্তু তাহাদেরই মতো একজন হকার, যে সব কাগজ তাহারা বিক্রয় করে সেই সব কাগজের লেখার মতো করিয়া সে লিখিতে পারিয়াছে, ইহা মনে করিয়া তাহারা গর্ব অনুভব করিত। কার্তিকদাদা আই, এ, পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন। নন-কোঅপারেশন করিয়া কলিকাতায় আসিয়া খবরের কাগজ বিক্রয় করিয়া তিনি নিজের খরচ চালাইতেছেন। তিনি নুট হামসুন ও ম্যাক্সিম গোর্কির জীবনী পড়িয়াছেন। আমাকে লইয়া তাঁহার গর্বের অন্ত ছিল না। কোনো শিক্ষিত লোকের সঙ্গে দেখা হইলেই সগর্বে আমাকে কবি বলিয়া পরিচয় করাইয়া দিতেন।

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৩)

১১:০০:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ মে ২০২৫
নজরুল
কিন্তু এসব উপদেশ আমার কানে প্রবেশ করিল না। এইভাবে প্রতিদিন সকালে উঠিয়া খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে ছুটিতাম। রাস্তায় দাঁড়াইয়া কাগজে বর্ণিত খবরগুলি উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করিতাম। মাঝে মাঝে কাগজের সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতাম। কলিকাতা শহরে কৌতূহলী লোকের অভাব নাই। তাহারা ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আমার বক্তৃতা শুনিত। কিন্তু কাগজ কিনিত না।
কাগজ বিক্রয় করিতে করিতে কার্তিকদাদার সঙ্গে পরিচয় হইল। বিক্রমপুরের কোন গ্রামে তাঁহার বাড়ি। তিনিও খবরের কাগজ বিক্রয় করিতেন। কিভাবে তাঁহার সঙ্গে আলাপ হইল, আজ সমস্ত মনে নাই। তবে এইটুকু মনে আছে, আমার অবিক্রীত কাগজগুলি কার্তিকদাদা বিক্রয় করিয়া দিতেন। আমারই মতো অনেক হকারের এটা-ওটা কাজ তিনি করিয়া দিতেন। সেইজন্য আমরা সকলে তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করিতাম।
আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে কার্তিকদাদা থাকিতেন। আমার বোনের বাড়িতে থাকার অসুবিধার কথা শুনিয়া কার্তিকদাদা আমাকে তাঁহার বাসায় উঠিয়া আসিতে বলিলেন। আট আনায় একটি মাদুর কিনিয়া লইয়া কার্তিকদাদার বাসায় উপস্থিত হইলাম। এক ভাঙা বাড়ির দ্বিতল কক্ষ কার্তিকদাদা ভাড়া লইয়াছিলেন। কক্ষটির সামনে প্রকাণ্ড খোলা ছাদ ছিল। সেই ছাদেই আমরা অধিকাংশ সময় যাপন করিতাম। বৃষ্টি হইলে সকলে ছাদ হইতে মাদুর গুটাইয়া আনিয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় লইতাম।
সকালে যে যার মতো খবরের কাগজ লইয়া বিক্রয় করিতে বাহির হইতাম। দেড়টা বাজিলে সকলে বাসায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর দুইটা তিনটার মধ্যে রান্না ও খাওয়া শেষ করিয়া তাড়াতাড়ি ছুটিয়া যাইতাম খবরের-কাগজের অফিসে। তখনকার দিনে বাংলা কাগজগুলি বিকালে বাহির হইত। রাত আটটা/নয়টা পর্যন্ত কাগজ বিক্রয় করিয়া বাসায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর রান্না-খাওয়াটা কোনো রকমে সারিয়া ছাদের উপর মাদুর বিছাইয়া তাহার উপর শ্রান্ত ক্লান্ত দেহটা ঢালিয়া দিতাম। আকাশে তারাগুলি মিটিমিটি করিয়া জ্বলিত। তাহাদের দিকে চাহিতে চাহিতে আমরা ঘুমাইয়া পড়িতাম। আকাশের তারাগুলি আমাদের দিকে চাহিয়া দেখিত কিনা কে জানে!
কোনো কোনো রাত্রে মোমবাতি জ্বালাইয়া কার্তিকদাদা আমার কবিতাগুলি সকলকে পড়িয়া শুনাইতেন। আমার সেই বয়সের কবিতায় কতটা মাধুর্য ছিল, আজ বলিতে পারিব না। সেই খাতাখানা হারাইয়া গিয়াছে। আর শ্রোতারা সেই সব কবিতার রস কতটা উপলব্ধি করিত, তাহাও আমার ভালো করিয়া মনে নাই। কিন্তু তাহাদেরই মতো একজন হকার, যে সব কাগজ তাহারা বিক্রয় করে সেই সব কাগজের লেখার মতো করিয়া সে লিখিতে পারিয়াছে, ইহা মনে করিয়া তাহারা গর্ব অনুভব করিত। কার্তিকদাদা আই, এ, পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন। নন-কোঅপারেশন করিয়া কলিকাতায় আসিয়া খবরের কাগজ বিক্রয় করিয়া তিনি নিজের খরচ চালাইতেছেন। তিনি নুট হামসুন ও ম্যাক্সিম গোর্কির জীবনী পড়িয়াছেন। আমাকে লইয়া তাঁহার গর্বের অন্ত ছিল না। কোনো শিক্ষিত লোকের সঙ্গে দেখা হইলেই সগর্বে আমাকে কবি বলিয়া পরিচয় করাইয়া দিতেন।

চলবে…..