১১:১৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
  • 83
নজরুল
জাতীয় বিদ্যালয়ের এই সব মাস্টারের চাইতে আমাদের ফরিদপুরের জেলা-ইস্কুলের দক্ষিণাবাবু কত সুন্দর পড়ান, যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয় কত ভালো পড়ান। আমার মনোবল ভাঙিয়া পড়িল। সারাদিন খবরের কাগজ বেচিয়া রাত্রে ছাদের উপর শুইয়া পড়িতাম, এ পাশের ও পাশের সহকর্মীরা ঘুমাইয়া পড়িত, কিন্তু আমার ঘুম আসিত না। মায়ের কথা ভাবিতাম, পিতার কথা ভাবিতাম। তাঁহারা আমার জন্য কত চিন্তা করিতেছেন। চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়া যাইত। এ আমি কি করিতেছি। এই ভাবে খবরের কাগজ বিক্রয় করিয়া জীবন কাটাইয়া দিব? আমি লেখাপড়া শিখিব না, মূর্খ হইয়া থাকিব? কে যেন অদৃশ্য স্থান হইতে আমার পিঠে সপাংসপাং করিয়া বেত্রাঘাত করিতেছে। নাঃ, আমি আর সময় নষ্ট করিব না। দেশে ফিরিয়া যাইব। দেশে ফিরিয়া গিয়া ভালোমতো লেখা পড়া করিয়া মানুষ হইব। আমি সংকল্প স্থির করিয়া ফেলিলাম।
দেশে ফিরিবার পূর্বে আমি কলিকাতার সাহিত্যিকদের কাছে পরিচিত হইয়া যাইব। ছেলেবেলা হইতে আমি সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুরাগী ছিলাম। তাঁহার সওগাত নামক গল্পগন্থখানিতে মুসলমানদের জীবন লইয়া কয়েকটি গল্প লেখা ছিল। তাহা ছাড়া চারুবাবুর লেখায় যে সহজ কবিত্ব মিশ্রিত ছিল, তাহাই আমাকে তাঁহার প্রতি অনুরাগী করিয়া তুলিয়াছিল। আমি ভাবিলাম, তাঁহার কাছে গেলে তিনি আমাকে উৎসাহ দিবেন। এমন কি, আমার একটি লেখা প্রবাসীতেও ছাপাইয়া দিতে পারেন। তিনি তখন প্রবাসীর সহকারী-সম্পাদক।
অনেক কষ্টে প্রবাসী-অফিসের ঠিকানা সংগ্রহ করিয়া একদিন সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তখনকার দিনে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে ব্রাহ্ম-সমাজের নিকটে এক বাড়ি হইতে প্রবাসী বাহির হইত। প্রবাসী-অফিসের দারোয়ানের কাছে চারুবাবুর সন্ধান করিতেই দারোয়ান মোটা একটি কালো লোককে দেখাইয়া আমাকে বলিল, উনিই চারুবাবু। সেই ভদ্রলোকের সামনে গিয়া সালাম করিয়া দাঁড়াইলাম।
“কি চাই?” বলিয়া তিনি আমাকে প্রশ্ন করিলেন।
আমি বলিলাম, “আমি কিছু কবিতা লিখেছি, আপনি যদি অনুগ্রহ করে পড়ে দেখেন বড় সুখী হব।”
ভদ্রলোক বলিলেন, “আমার তো সময় নাই।”
অতি বিনয়ের সঙ্গে বলিলাম, “বহুকাল হতে আপনার লেখা পড়ে আমি আপনার অনুরাগী হয়েছি। আপনি সামান্য একটু যদি সময়ের অপব্যয় করেন।”

এই বলিয়া আমি বগলের তলা হইতে আমার কবিতার খাতাখানা তাঁর সামনে টানিয়া ধরিতে উদ্যত হইলাম। ভদ্রলোক যেন ছুৎমার্গগ্রস্ত কোনো হিন্দু বিধবার মতো অনেকটা দূরে সরিয়া গিয়া আমাকে বলিলেন, “আজ আমার মোটেই সময় নাই।” কিন্তু ডুবন্ত লোকের মতো এই তৃণখণ্ডকে আমি কিছুতেই ছাড়িতে পারিতেছিলাম না। কাকুতি মিনতি করিয়া তাঁহাকে বলিলাম, “একদিন যদি সামান্য কয়েক মিনিটের জন্যও সময় করেন।” ভদ্রলোকের দয়া হইল। তিনি আমাকে ছয় সাত দিন পরে নির্দিষ্ট সময়ে আসিতে বলিলেন। তখন আমার প্রবাসের নৌকার নোঙর ছিঁড়িয়াছে। দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য আমার মন আকুলি বিকুলি করিতেছে। তবুও আমি কয়দিন কলিকাতায় রহিয়া গেলাম। আমার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, একবার যদি তাঁহাকে দিয়া আমার একটি কবিতা পড়াইতে পারি, তবে তিনি আমাকে অতটা অবহেলা করিবেন না। নিশ্চয়ই তিনি আমার কবিতা পছন্দ করিবেন।

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৮৫)

১১:০০:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫
নজরুল
জাতীয় বিদ্যালয়ের এই সব মাস্টারের চাইতে আমাদের ফরিদপুরের জেলা-ইস্কুলের দক্ষিণাবাবু কত সুন্দর পড়ান, যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয় কত ভালো পড়ান। আমার মনোবল ভাঙিয়া পড়িল। সারাদিন খবরের কাগজ বেচিয়া রাত্রে ছাদের উপর শুইয়া পড়িতাম, এ পাশের ও পাশের সহকর্মীরা ঘুমাইয়া পড়িত, কিন্তু আমার ঘুম আসিত না। মায়ের কথা ভাবিতাম, পিতার কথা ভাবিতাম। তাঁহারা আমার জন্য কত চিন্তা করিতেছেন। চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়া যাইত। এ আমি কি করিতেছি। এই ভাবে খবরের কাগজ বিক্রয় করিয়া জীবন কাটাইয়া দিব? আমি লেখাপড়া শিখিব না, মূর্খ হইয়া থাকিব? কে যেন অদৃশ্য স্থান হইতে আমার পিঠে সপাংসপাং করিয়া বেত্রাঘাত করিতেছে। নাঃ, আমি আর সময় নষ্ট করিব না। দেশে ফিরিয়া যাইব। দেশে ফিরিয়া গিয়া ভালোমতো লেখা পড়া করিয়া মানুষ হইব। আমি সংকল্প স্থির করিয়া ফেলিলাম।
দেশে ফিরিবার পূর্বে আমি কলিকাতার সাহিত্যিকদের কাছে পরিচিত হইয়া যাইব। ছেলেবেলা হইতে আমি সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুরাগী ছিলাম। তাঁহার সওগাত নামক গল্পগন্থখানিতে মুসলমানদের জীবন লইয়া কয়েকটি গল্প লেখা ছিল। তাহা ছাড়া চারুবাবুর লেখায় যে সহজ কবিত্ব মিশ্রিত ছিল, তাহাই আমাকে তাঁহার প্রতি অনুরাগী করিয়া তুলিয়াছিল। আমি ভাবিলাম, তাঁহার কাছে গেলে তিনি আমাকে উৎসাহ দিবেন। এমন কি, আমার একটি লেখা প্রবাসীতেও ছাপাইয়া দিতে পারেন। তিনি তখন প্রবাসীর সহকারী-সম্পাদক।
অনেক কষ্টে প্রবাসী-অফিসের ঠিকানা সংগ্রহ করিয়া একদিন সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তখনকার দিনে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে ব্রাহ্ম-সমাজের নিকটে এক বাড়ি হইতে প্রবাসী বাহির হইত। প্রবাসী-অফিসের দারোয়ানের কাছে চারুবাবুর সন্ধান করিতেই দারোয়ান মোটা একটি কালো লোককে দেখাইয়া আমাকে বলিল, উনিই চারুবাবু। সেই ভদ্রলোকের সামনে গিয়া সালাম করিয়া দাঁড়াইলাম।
“কি চাই?” বলিয়া তিনি আমাকে প্রশ্ন করিলেন।
আমি বলিলাম, “আমি কিছু কবিতা লিখেছি, আপনি যদি অনুগ্রহ করে পড়ে দেখেন বড় সুখী হব।”
ভদ্রলোক বলিলেন, “আমার তো সময় নাই।”
অতি বিনয়ের সঙ্গে বলিলাম, “বহুকাল হতে আপনার লেখা পড়ে আমি আপনার অনুরাগী হয়েছি। আপনি সামান্য একটু যদি সময়ের অপব্যয় করেন।”

এই বলিয়া আমি বগলের তলা হইতে আমার কবিতার খাতাখানা তাঁর সামনে টানিয়া ধরিতে উদ্যত হইলাম। ভদ্রলোক যেন ছুৎমার্গগ্রস্ত কোনো হিন্দু বিধবার মতো অনেকটা দূরে সরিয়া গিয়া আমাকে বলিলেন, “আজ আমার মোটেই সময় নাই।” কিন্তু ডুবন্ত লোকের মতো এই তৃণখণ্ডকে আমি কিছুতেই ছাড়িতে পারিতেছিলাম না। কাকুতি মিনতি করিয়া তাঁহাকে বলিলাম, “একদিন যদি সামান্য কয়েক মিনিটের জন্যও সময় করেন।” ভদ্রলোকের দয়া হইল। তিনি আমাকে ছয় সাত দিন পরে নির্দিষ্ট সময়ে আসিতে বলিলেন। তখন আমার প্রবাসের নৌকার নোঙর ছিঁড়িয়াছে। দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য আমার মন আকুলি বিকুলি করিতেছে। তবুও আমি কয়দিন কলিকাতায় রহিয়া গেলাম। আমার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, একবার যদি তাঁহাকে দিয়া আমার একটি কবিতা পড়াইতে পারি, তবে তিনি আমাকে অতটা অবহেলা করিবেন না। নিশ্চয়ই তিনি আমার কবিতা পছন্দ করিবেন।

চলবে…..