সারাক্ষণ রিপোর্ট
আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস ২০২৫ । প্রতি বছর ৮ মে সারাবিশ্বে থ্যালাসেমিয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশনের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা পানস ইংলেজোস ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক থ্যালাসেমিয়া দিবসের প্রবর্তক। তাঁর ছেলে জর্জের মৃত্যু হয়েছিল থ্যালাসেমিয়ায়।এইজন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হয়। থ্যালাসেমিয়া রক্তের এমন একটি মারাত্মক রোগ যা শিশুরা বংশগতভাবে তাদের পিতা- মাতা থেকে পেয়ে থাকে।রক্তে যদি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকে তাহলে থ্যালাসেমিয়া হয়।
এর ফলে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক প্রায় ২৫০ মিলিয়ন। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ১৪ জনে একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছে। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া বাহকের সংখ্যা দেড় থেকে ২ কোটি বলে মনে করা হয়। প্রতি বছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার। তবে সচেতনতার অভাব ও শনাক্ত না হওয়ায় প্রতিনিয়ত এ রোগের বাহক ও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
থ্যালাসেমিয়া কী: ১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি চিহ্নিত করেন। ‘থ্যালাসেমিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গ্রিক শব্দ ‘থালসা’ এর ইংরেজি শব্দ’রক্তাল্পতা”সহযোগে থ্যালাসেমিয়া শব্দটি তৈরি। ‘থালসা ’ অর্থ ভূমধ্যসাগরীয় এবং এ্যানিমিয়া অর্থ ‘রক্তাল্পতা’। ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোতে প্রথম এ রোগ আবিষ্কার হয় বলে এর নামকরণ হয় থ্যালাসেমিয়া। ভূমধ্যসাগর ছাড়া আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
কারণ– ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীন হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশে ত্রুটি সৃষ্টি করে। ফলে লোহিত রক্তকণিকার আয়ু স্বাভাবিক ১২০ দিন থেকে কমে মাত্র ২০-৬০ দিনে নেমে আসে। অপরিপক্ক লোহিত রক্তকণিকার ভাঙনের দরুণ রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। বাবা-মা দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%, বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ২৫%। ভাই-বোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারে কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তান-সন্ততির থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
প্রকার: থ্যালাসেমিয়া প্রধানত ২ ধরনের। যথা- আলফা এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। ১৬ নম্বর ক্রোমোসমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং ১১ নম্বর ক্রোমোসমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। আলফা থ্যালাসেমিয়া আবার আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (হাইড্রপস ফিটালিস) ও আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (হিমোগ্লোবিন-এইচ ডিজিজ/আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট) এ ২ রকম হতে পারে। যেখানে প্রথমটি অনেক মারাত্মক। বিটা থ্যালাসেমিয়া অনুরূপভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর (কুলি’স এনিমিয়া) ও বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (ট্রেইট) ২ রকম হতে পারে। এক্ষেত্রেও প্রথমটিই মারাত্মক বেশি। থ্যালাসেমিয়া বিভিন্ন হিমোগ্লোবিনোপ্যাথির সাথে একইসাথে সহাবস্থান করতে পারে। এদের মধ্যে আমাদের দেশে প্রধানত হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া পাওয়া যায়। সামগ্রিকভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া, আলফা থ্যালাসেমিয়া অপেক্ষা বেশি তীব্র ও মারাত্মক।
লক্ষণ: বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জন্মের ২-৩ বছরের মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পায়।।
– জন্ডিস ও ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণে শিশুদের জন্ডিস হতে পারে এবং তাদের ত্বক ফ্যাকাশে দেখাতে পারে।
– থ্যালাসেমিয়া হলে অনেক বেশি পরিমাণে তন্দ্রা লেগে থাকা ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
– থ্যালাসেমিয়ার কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে।
– হাত পা ঠণ্ডা হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
– নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
– থ্যালাসেমিয়ার কারণে পায়ে ক্রাম্প হতে পারে।
– থ্যালাসেমিয়া হলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
– অনেক সময় থ্যালাসেমিয়া হলে শিশুরা আর খেতে চায় না বা খাবারে অনীহা দেখা দিতে পারে।
– থ্যালাসেমিয়ার কারণে শিশুদের বৃদ্ধিতে বিলম্ব দেখা দিতে পারে বা শিশুরা ঠিক মতো বেড়ে ওঠে না।
– অনেক সময় মাথাব্যথা দেখা দিতে পারে।
– মাথা ঘোরা ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
– ইনফেকশন বা সংক্রমণে সহজেই প্রভাবিত হওয়া এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
থ্যালাসেমিয়া–সম্পর্কিত স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ–
সংক্রমণ
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিশেষ করে যদি তারা অনেক রক্ত গ্রহণ করে। আপনার প্লীহা অপসারণ করা হলে কিছু সংক্রমণ আরও খারাপ হতে পারে।
হাড়ের সমস্যা
থ্যালাসেমিয়া মুখের এবং মাথার খুলির হাড়ের বিকৃতি হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের গুরুতর অস্টিওপরোসিস (ভঙ্গুর হাড়) হতে পারে।আপনার রক্তে অনেক বেশি আয়রন
এটি হার্ট, লিভার বা এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের ক্ষতি করতে পারে (শরীরে হরমোন উৎপাদনকারী গ্রন্থি, যেমন থাইরয়েড এবং অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি)।
হিমোগ্লোবিনের মান ঠিক রাখার ঘরোয়া পরামর্শঃ–
আয়রনসমৃদ্ধ খাবারঃ–শরীরে লোহার ঘাটতি হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার অন্যতম সাধারণ কারণ। হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনে লোহা গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আয়রনসমৃদ্ধ কিছু খাবার হলো কলিজা, লাল মাংস, চিংড়ি, পালংশাক, আমন্ড, খেজুর, শতমূলী ইত্যাদি।
ভিটামিন সিঃ– ভিটামিন সি-এর অভাবে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। তাছাড়া ভিটামিন সি ছাড়া আয়রন পুরোপুরিভাবে শোষণ হয় না। পেঁপে, কমলা, লেবু, স্ট্রবেরি, গোলমরিচ, ব্রোকলি, আঙ্গুর, টমেটো ইত্যাদিতে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে।
ফলিক অ্যাসিডঃ–ফলিক অ্যাসিড এক প্রকার ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। লাল রক্তকণিকা তৈরিতে এটি প্রয়োজনীয় উপাদান। সবুজ পাতাযুক্ত সবজি, কলিজা, ভাত, শিমের বিচি, বাদাম, কলা, ব্রোকলিতে প্রচুর ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়।
বিটঃ-হিমোগ্লোবিন বাড়াতে বিটের রস খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। এতে রয়েছে প্রচুর আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ফাইবার ও পটাশিয়াম।
আপেলঃ-দিনে একটি করে আপেল খেয়ে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে পারেন। আয়রনের উৎস আপেলে আরো নানা পুষ্টি উপাদান রয়েছে। প্রতিদিন খোসাসহ একটি আপেল খান। অথবা সমানুপাতে আপেল ও বিটের রস মেশাতে পারেন।
ডালিমঃ– আয়রন, ক্যালসিয়াম, শর্করা ও আঁশসমৃদ্ধ ডালিম রক্তে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে দেহে রক্ত চলাচল সচল রাখে। প্রতিদিন মাঝারি আকৃতির একটি ডালিম খাওয়ার চেষ্টা করুন। অথবা এক গ্লাস ডালিমের জুস খান।