সারাক্ষণ রিপোর্ট
স্মার্টফোনে নির্ভরশীল এক অনিরাপদ গ্রহ
এখন বিশ্বের আনুমানিক ৭.২ বিলিয়ন মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন, যা মোবাইল‑কেন্দ্রিক অর্থনীতি ও সমাজকে আরও বিস্তৃত করেছে। একই সময়ে, ২০২৪ সালের শেষে বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫.৩৫ বিলিয়ন ছাড়ালেও অনলাইন ঝুঁকির মাত্রা দ্রুত বাড়ছে।
২. বৈশ্বিক মোবাইল নিরাপত্তা হুমকি
- স্মিশিং ও সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং:মোবাইল‑টার্গেট করা ফিশিং (স্মিশিং) এখন নথিভুক্ত সকল হুমকির এক‑তৃতীয়াংশ; এসব আক্রমণের দুই‑তৃতীয়াংশই এসএমএস‑নির্ভর স্মিশিং।
• ম্যালওয়্যার ও সাপ্লাই চেইন: এক‑চতুর্থাংশ ডিভাইস পুরোনো বা আপগ্রেডযোগ্য নয়, ফলে জিরো‑ডে দুর্বলতা মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
• পেগাসাস ও শূন্য‑ক্লিক স্পাইওয়্যার: ২০২৫ সালে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের অপব্যবহারে সাংবাদিক ও কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ঘটনা বাড়ছে; যুক্তরাষ্ট্রের আদালত এনএসও গ্রুপকে ১৬৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দিয়েছে।
• টেলকো অবকাঠামোতে আক্রমণ: জেনারেটিভ এআই ও অটোমেশন সাইবার অপরাধীদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে, ফলে টেলকো নেটওয়ার্কে ডিডিওএস ও ডেটা এক্সফিলট্রেশন দ্রুত বাড়ছে।
শিল্পের প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা
জিএসএমএর ২০২৫ সালের ‘সিকিউরিটি ল্যান্ডস্কেপ’ মোবাইল নেটওয়ার্ককে ‘ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ ঘোষণা করে পাঁচটি মূল কৌশল—সমন্বিত প্রতিরক্ষা, নেটওয়ার্ক‑জ্ঞান, অবকাঠামো সুরক্ষা, সাপ্লাই‑চেইন নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ‑প্রস্তুতি—উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশ: সংযোগের বিস্তার, অনিশ্চয়তার ভার
- ব্যাপক ব্যবহার:২০২৫ সালের শুরুতে ১৮৫ মিলিয়ন মোবাইল সংযোগ সক্রিয়; ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৭৭.৭ মিলিয়ন—জনসংখ্যার ৪৪.৫ শতাংশ।
• উদ্বেগের মাত্রা: টেলিনর এশিয়ার সমীক্ষায় প্রতি ১০ জনে ৭ জন ব্যবহারকারী অনলাইন অ্যাকাউন্ট‑নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন। নেটওয়ার্ক হামলাও বড় শঙ্কা; প্রতি ১০ জনে ৩ জন এটিকে শীর্ষ হুমকি বলেছেন, যা সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের তুলনায় দ্বিগুণ।
• লিঙ্গ বৈষম্য ও দক্ষতার ঘাটতি: কর্মক্ষেত্রে এআই‑টুল ব্যবহারে পুরুষ‑নারী ব্যবধান স্পষ্ট; নিরাপত্তা সচেতনতা কর্মসূচির অভাবও ঝুঁকি বাড়ায়।
স্বৈরশাসনে নিরাপত্তা নাকি নজরদারি?
বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (২০১৮) ও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (২০২৩) দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচিত—রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও গ্রেপ্তারের হাতিয়ার হিসেবে। নতুন সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স (২০২৪) ‘নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেটের অধিকার’ যুক্ত করলেও সরকারি নির্দেশেই গত এক দশকে অন্তত ৩৪ বার ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছে। এসব শাটডাউন, কনটেন্ট অপসারণের ক্ষমতা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডেটাকে অনিরাপদ ও ভীত পর্যবেক্ষণের মুখে ফেলে।
পাশাপাশি, সিটিজেন ল্যাবের গবেষণায় পেগাসাস অপারেটর ‘GANGES’-এর মাধ্যমে ২০১৬–১৮ সালে বাংলাদেশেও টার্গেটিংয়ের আলামত মিলেছে।
ঝুঁকি কমাতে নীতিগত ও প্রযুক্তিগত করণীয়
- আইনি সংস্কার ও স্বচ্ছতা:শাটডাউন নিয়ন্ত্রণে বিচারিক অনুমোদন, স্বাধীন টেলিকম নিয়ন্ত্রক ও সংসদীয় নজরদারি প্রয়োজন।
• স্মার্টফোন সুরক্ষা মানদণ্ড: আমদানি পর্যায়ে সিকিউরিটি আপডেটের ন্যূনতম মেয়াদ (কমপক্ষে ৩ বছর) বাধ্যতামূলক করা।
• জনসচেতনতা ও দক্ষতা: টু‑ফ্যাক্টর প্রমাণীকরণ, নিয়মিত ওএস আপডেট, সাইডলোড এড়ানো এবং ফিশিং শনাক্তে গণমাধ্যম‑ভিত্তিক প্রশিক্ষণ জোরদার করা।
• আঞ্চলিক সহযোগিতা: সার্ক বা বিমসটেক পর্যায়ে মোবাইল থ্রেট‑ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম গঠন; অপারেটর‑ভিত্তিক সুরক্ষা এপিআই (GSMA Open Gateway) দ্রুত বাস্তবায়ন।
বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন‑নির্ভরতার সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে নিরাপত্তা হুমকিও বাড়ছে। গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা আর প্রযুক্তিগত সেরা চর্চা একত্রে কার্যকর না হলে বাংলাদেশসহ যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রবল, সেখানে মোবাইল ফোন সহজেই নাগরিক স্বাধীনতার বিপরীতে নজরদারির যন্ত্রে পরিণত হতে পারে। নিরাপদ, সুরক্ষিত ও মানবাধিকার‑সম্মত ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে নীতি‑নির্ধারক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবহারকারীদের সমন্বিত পদক্ষেপই এখন সময়ের দাবি।