চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কি সরকারের ইচ্ছায় কারাগারে থাকতে হচ্ছে? মামলার ধরনে এমন প্রশ্ন উঠছে৷ চিন্তক ফরহাদ মজহার মনে করেন, বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রকে ‘ভুয়া‘ মামলায় পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে রাখা হয়েছে৷
গত শুক্রবার (০২.০৫.২০২৫) উচ্চ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে জামিন দেয়৷ কিন্তু জামিন দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে জামিন স্থগিত করে দেয়।
পাঁচ মাসেরও বেশি সময় নানাভাবে, নানা কারণে শুনানি পিছানোর পর মঙ্গলবার আবার শুনারির দিন ধার্য হয়৷ কিন্তু শুনানির আগেই চিন্ময় এবং তার আইনজীবীকে চট্টগ্রামের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর দাবিতে মিছিল হয় চট্টগ্রামে। মিছিলকারীদের সেই দাবি পূরণও হয় সেদিন৷ ভার্চুয়াল শুনানি শেষে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলাসহ চারটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখান চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম এস এম আলাউদ্দিন। শুনানিতে চিন্ময়ের কোনো আইনজীবী অংশ নিতে পারেননি।
২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর চিন্ময় দাসকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশ করে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ। সেই সমাবেশের পাঁচ দিন পর, ৩১ অক্টোবর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ এনে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন বিএনপি নেতা ফিরোজ খান।
ফিরোজের অভিযোগ, ২৫ অক্টোবর নিউমার্কেট এলাকায় জাতীয় পতাকার সাথে গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন চিন্ময়। তবে ওই সময় চিন্ময় ছিলেন লালদীঘি ময়দানে। পরে মামলাকারী ফিরোজ খানকে বহিষ্কার করে বিএনপি৷
২৫ নভেম্বর ঢাকায় গ্রেপ্তারের পরের দিন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও হাটহাজারীর পুন্ডরিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে চট্টগ্রাম আদালতে নেয়া হয়৷ আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ আদেশের প্রতিবাদে আদালত চত্ত্বরে চিন্ময়ের বিক্ষুব্ধ অনুসারীরা প্রিজনভ্যানের চারদিকে শুয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সরিয়ে দিতে টিয়ারসেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে এক পর্যায়ে আদালত এলাকা থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরে রঙ্গম কমিউনিটি সেন্টারের পাশে সহকারি সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ।
রোববার সেই মামলাতেও চিন্ময়কে গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ মঙ্গলবার আরো চারটি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে৷
রাষ্ট্রদ্রোহ ও আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ হত্যা মামলা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে চিন্ময় দাসের আইজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, “রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। আর হত্যাসহ বিস্ফোরক ও ভাঙচুরের যে চারটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, সে সময়ে তিনি পুলিশ হেফাজতে আদালতে ছিলেন।”
রোববারের চারটি মামলার এজাহারে চিন্ময়ের নাম নেই বলেও জানান তিনি। তারপরও নির্দেশদাতা হিসাবে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি কিভাবে নির্দেশ দিলেন? পুলিশের অজান্তে বা পুলিশের সহায়তা ছাড়া তা কি সম্ভব? এসব প্রশ্নের উত্তর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিনের কাছ থেকেও পাওয়া যায়নি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি শুধু বলেছেন, “কারাগারে থাকা চিন্ময় দাসকে কোতোয়ালি থানার হত্যা মামলাসহ অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ নিয়ে আমার আর কিছু বলার নাই।” এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্যও জানার চেষ্টা করা হয়েছে৷ তবে তিনি ফোন ধরেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকা সত্ত্বেও চিন্ময়কে মামলার আসামি করা প্রসঙ্গে পিপি অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক বলেন, ‘‘তাকে তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এখন তার সংশ্লিষ্টতা কী সেটা তো আমরা বলতে পারবো না, সেটা তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন দিলে বলতে পারবো।”
আইজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘চিন্ময় দাসের ব্যাপারে যা হচ্ছে, তা নিপীড়নমূলক৷’’
আইনজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য জানান, তার মক্কেল চিন্ময় কৃষ্ণ দাস আইনি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন৷ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৮২ জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের মামলা দেয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে তার বক্তব্যে৷ ডয়চে ভেলেকে অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ” রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার পর চট্টগ্রামের আদালত তাকে (চিন্ময়) জামিন দেয়নি। কোনো আইনজীবীকেই জামিনের জন্য দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। হুমকি দেয়া হয়েছে। আইনজীবী হিসাবে তার পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে পারেন এরকম ৮২ জন সংখ্যালঘু আইনজীবীকে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়েছে। পরে আমি নিজে আইনজীবীদের নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে জামিনের আবেদন করেও জামিন পাইনি। হাইকোর্ট বুধবার জামিন দিলেও অন্য মামলায় আটকে দেয়া হলো।”
‘চিন্ময়বিরোধীরা’ জামিনের আগেও জামিন না দেয়ার জন্য হুমকি দেয়। জামিন পাওয়ার পরও হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর দাবিতে মিছিলে নামে তাদের একাংশ।
আইনজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ” চিন্ময় দাসের ব্যাপারে যা হচ্ছে, তা নিপীড়নমূলক। কোনো ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও তাকে কারাগারে যেতে হলো। আবার জামিন পাওয়ার পরও নতুন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো, যে ঘটনার সময় তিনি পুলিশ কাস্টডিতে ছিলেন। এটা তাকে দীর্ঘ সময় কারাগারে রাখার কৌশল। এমনকি আইনজীবী সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আইনজীবীকে তার পক্ষে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।”
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্যের এ অভিযোগের জবাবে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আলি বলেন,” আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে কাউকে আইনজীবী হতে বাধা দেইনি। কোনো লিখিত নাই। তবে যেহেতু একজন আইনজীবী নিহত হয়েছেন, তাই আইনজীবীরা আবেগে কেউ চিন্ময়ের পক্ষে যাচ্ছেন না। আর ৮২ জন আইনজীবীকে অন্য মামলায় আসামি করা হয়েছে। ”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,” চিন্ময় দাসকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো একান্তই রাষ্ট্রের বিষয়। রাষ্ট্র চেয়েছে, গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।” ভার্চুয়াল শুনানির ব্যাপারে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আলি বলেন, “চিন্ময়কে আদালতে নিলে ঝামেলা হয়। তাই ভার্চুয়াল শুনানি হয়েছে।”
‘এখানে আইন, সংবিধান কিছুই মানা হচ্ছে না’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন,”এটা পাবলিক নয়, সরকার তাকে (চিন্ময়) মামলায় ঢুকাচ্ছে। সরকার চাইছে তাকে কারাগারে রাখতে, তাই কারাগারে রাখছে। এখানে আইন, সংবিধানের প্রশ্ন তুলে কী লাভ হবে? যারা চিন্ময়ের বিরুদ্ধে, তাদের প্রতি সরকারের দুর্বলতা আছে। সব মুসলমান কিন্তু এটা চাইছে না। আমিও তো একজন মুসলমান। আমি তো এটা চাই না। যে বিচারপতি তাকে জামিন দিয়েছেন, তিনি একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম।”
তার কথা, ‘‘তাকে নতুন মামলায় জড়ানো হলো, হত্যা মামলায়। এক গ্রুপ দাবি করলো আর তাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো। এখন যেটা হলো, এই মামলায় চট্টগ্রাম আদালতে আগে জামিন চাইতে হবে। সেখানে জামিন না পেলে উচ্চ আদালতে যাওয়া যাবে। কিন্তু চট্টগ্রামের আদালতে তো কোনো আইনজীবী দাঁড়াতে পারবে না। ফলে তার জামিন কীভাবে হবে বলা মুশকিল।”
“আসলে সরকার তাকে কারাগারে রাখতে চাইছে। কোনো এক গোষ্ঠীকে খুশি করতে এটা করা হচ্ছে। এখানে আইন, সংবিধান কিছু মানা হচ্ছে না,” বলেন তিনি।
‘চিন্ময়ের বিরুদ্ধে দুইটি মামলাই ভুয়া’
চিন্তক ফরহাদ মজহার চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে মামলা ও তাকে কারাবন্দি রাখার বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন তুলে আসছেন৷ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে একবার সরাসরিও এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন৷ নতুন মামলায় চিন্ময়কে আটক দেখানোর পর ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন,” চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহেরমামলা ভুয়া। এর কোনো ভিত্তি নাই। এই মামলাটি করেছেন বিএনপির একজন সদস্য। তাকে বিএনপি দল থেকে বরখাস্ত করেছে, কিন্তু মামলা তোলেনি। মামলাটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কে একজন গেরুয়া পতাকা উড়িয়েছে এটার জন্য তো তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা না। যে উড়িয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে বড়জোর। আর পতাকা ওড়ানো হয়েছিল উনি যেখানে বক্তৃতা দেন, সেখান থেকে বেশ দূরে। দ্বিতীয়ত, আপনি যখন গণঅভ্যুত্থানের পরে ব্রিটিশ কলোনিয়াল রাষ্ট্রদ্রোহের আইনে মামলা করবেন, সেটা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাবিরোধী। ওই আইনটি একেবারেই নাগরিক অধিকারের বিরোধী। গণ অভ্যুত্থানের পর নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হয়েছে। তারা তো তাদের অধিকারের কথা বলতে পারেন। আর জামিন পাওয়া তো অধিকার।”
তিনি মনে করেন, ” যারা বাংলাদেশের ভিতরে দিল্লির হিন্দুত্ববাদী স্বার্থ রক্ষা করে, তারা পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা লাগাবার জন্য এটা করছে।আজকে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।”
“পরের যে হত্যা মামলা, এজাহারে কি তার নাম আছে? এজাহারে নাম না থাকার পরও তাকে সেই মামলায় গ্রেপ্তার করা অযৌক্তিক। তিনি তো ঘটনার সময় পুলিশ কাস্টডিতে ছিলেন,” বলেন তিনি।
ফরহাদ মজহার আরো বলেন,”বাংলাদেশের নতুন যে আইজিপি, তার সঙ্গে আইন উপদেষ্টা, তাদের তো বোঝা উচিত এটা দিল্লির স্বার্থের পক্ষে যাচ্ছে। তারা কি দিল্লির পক্ষে কাজ করছেন, যাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে? এতে সরকার দুর্বল হয়।”