০৫:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫

বিনিময় হার নমনীয় করে আইএমএফ-এর ঋণ পাবার চেষ্টা

Reporter Name
  • Update Time : ০৩:৪৩:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
  • / ২৭ Time View

সারাক্ষণ রিপোর্ট

আইএমএফ ঋণ: বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশ ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজ অনুমোদন পায়। এই ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭৬.৩ মিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এবং দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮২ মিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাওয়া যায়। তৃতীয় কিস্তি ১.১৫ বিলিয়ন ডলার ২০২৪ সালের ২৪ জুন ছাড় হয়। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি—যথাক্রমে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার করে—ছাড়ে বিলম্ব হচ্ছে। মূলত, ডলার-টাকা বিনিময় হার আরও নমনীয় করার বিষয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ না হওয়ায় এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

বিনিময় হার নিয়ে মতবিরোধ

আইএমএফ বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর জন্য চাপ দিচ্ছে, যেখানে ডলার-টাকার বিনিময় হার বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আশঙ্কা করছে, এই পদক্ষেপের ফলে বিনিময় হারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক “ক্রলিং পেগ” পদ্ধতি অনুসরণ করছে, যেখানে বিনিময় হার একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করতে পারে। আইএমএফ এই সীমা ১০% পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও, বাংলাদেশ ব্যাংক ২-৩% সীমার মধ্যে রাখতে চাচ্ছে।

সমঝোতার সম্ভাবনা

সাম্প্রতিক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফ কিছুটা নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে। উভয় পক্ষ ৫-৬% সীমার মধ্যে বিনিময় হার ওঠানামার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এই সমঝোতার ফলে আগামী জুন মাসে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির মোট ১.৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

রাজস্ব সংগ্রহ ও আর্থিক খাত সংস্কার

আইএমএফের আরেকটি প্রধান শর্ত হলো রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো। বর্তমানে এটি প্রায় ৮.৫%। আইএমএফ চায় এটি ৫% পর্যন্ত বাড়ানো হোক। এছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রশাসন ও নীতিনির্ধারণী বিভাগের পৃথকীকরণ এবং কর অব্যাহতির পরিমাণ কমানোও শর্তের মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে আগামী অর্থবছরে অতিরিক্ত ৪০,০০০ কোটি টাকা কর আদায়ের পরিকল্পনা করেছে, যা জিডিপির ০.৭% সমান।

স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের প্রস্তাব

বিনিময় হার আরও নমনীয় করার ক্ষেত্রে বাজারে অস্থিরতা মোকাবিলায় বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ১ বিলিয়ন ডলারের স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড চেয়েছে। এই ফান্ডের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ডলার লেনদেন বা বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

অর্থ উপদেষ্টা: “আইএমএফ ঋণ ছাড়াই বাজেট প্রস্তুত করা হবে”

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, “আমরা আইএমএফের ঋণ ছাড়াই বাজেট প্রস্তুত করব।” তিনি আরও বলেন, “আমরা আইএমএফের শর্ত পূরণে কাজ করছি, তবে বাজেট প্রস্তুতির জন্য তাদের ঋণের ওপর নির্ভর করছি না।”

অর্থনীতিবিদদের মতামত

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ না করলে শুধু এই ঋণ নয়, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী যেমন বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তাও বিঘ্নিত হতে পারে। এছাড়া, বৈশ্বিক রেটিং সংস্থাগুলো বাংলাদেশের রেটিং কমিয়ে দিতে পারে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা পাঠাবে।

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফের মধ্যে চলমান আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি। আগামী মাসে আইএমএফের বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, বিনিময় হার আরও নমনীয় করা এবং আর্থিক খাতের সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফের শর্ত পূরণ করে ঋণ কিস্তি ছাড় পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে, যা আমদানি ব্যয় মেটাতে সহায়তা করবে। তবে বিনিময় হার আরও নমনীয় করার ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

About Author Information

বিনিময় হার নমনীয় করে আইএমএফ-এর ঋণ পাবার চেষ্টা

Update Time : ০৩:৪৩:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

আইএমএফ ঋণ: বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশ ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজ অনুমোদন পায়। এই ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭৬.৩ মিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এবং দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮২ মিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাওয়া যায়। তৃতীয় কিস্তি ১.১৫ বিলিয়ন ডলার ২০২৪ সালের ২৪ জুন ছাড় হয়। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি—যথাক্রমে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার করে—ছাড়ে বিলম্ব হচ্ছে। মূলত, ডলার-টাকা বিনিময় হার আরও নমনীয় করার বিষয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ না হওয়ায় এই জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

বিনিময় হার নিয়ে মতবিরোধ

আইএমএফ বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর জন্য চাপ দিচ্ছে, যেখানে ডলার-টাকার বিনিময় হার বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আশঙ্কা করছে, এই পদক্ষেপের ফলে বিনিময় হারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক “ক্রলিং পেগ” পদ্ধতি অনুসরণ করছে, যেখানে বিনিময় হার একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করতে পারে। আইএমএফ এই সীমা ১০% পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও, বাংলাদেশ ব্যাংক ২-৩% সীমার মধ্যে রাখতে চাচ্ছে।

সমঝোতার সম্ভাবনা

সাম্প্রতিক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফ কিছুটা নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে। উভয় পক্ষ ৫-৬% সীমার মধ্যে বিনিময় হার ওঠানামার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এই সমঝোতার ফলে আগামী জুন মাসে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির মোট ১.৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

রাজস্ব সংগ্রহ ও আর্থিক খাত সংস্কার

আইএমএফের আরেকটি প্রধান শর্ত হলো রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো। বর্তমানে এটি প্রায় ৮.৫%। আইএমএফ চায় এটি ৫% পর্যন্ত বাড়ানো হোক। এছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রশাসন ও নীতিনির্ধারণী বিভাগের পৃথকীকরণ এবং কর অব্যাহতির পরিমাণ কমানোও শর্তের মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে আগামী অর্থবছরে অতিরিক্ত ৪০,০০০ কোটি টাকা কর আদায়ের পরিকল্পনা করেছে, যা জিডিপির ০.৭% সমান।

স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের প্রস্তাব

বিনিময় হার আরও নমনীয় করার ক্ষেত্রে বাজারে অস্থিরতা মোকাবিলায় বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ১ বিলিয়ন ডলারের স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড চেয়েছে। এই ফান্ডের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ডলার লেনদেন বা বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

অর্থ উপদেষ্টা: “আইএমএফ ঋণ ছাড়াই বাজেট প্রস্তুত করা হবে”

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, “আমরা আইএমএফের ঋণ ছাড়াই বাজেট প্রস্তুত করব।” তিনি আরও বলেন, “আমরা আইএমএফের শর্ত পূরণে কাজ করছি, তবে বাজেট প্রস্তুতির জন্য তাদের ঋণের ওপর নির্ভর করছি না।”

অর্থনীতিবিদদের মতামত

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আইএমএফের শর্ত পূরণ না করলে শুধু এই ঋণ নয়, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী যেমন বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তাও বিঘ্নিত হতে পারে। এছাড়া, বৈশ্বিক রেটিং সংস্থাগুলো বাংলাদেশের রেটিং কমিয়ে দিতে পারে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা পাঠাবে।

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফের মধ্যে চলমান আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি। আগামী মাসে আইএমএফের বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, বিনিময় হার আরও নমনীয় করা এবং আর্থিক খাতের সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এই মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফের শর্ত পূরণ করে ঋণ কিস্তি ছাড় পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে, যা আমদানি ব্যয় মেটাতে সহায়তা করবে। তবে বিনিময় হার আরও নমনীয় করার ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং জনগণের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।