সারাক্ষণ রিপোর্ট
বেজিংয়ে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন
চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ১২ মে বেজিংয়ে ল্যাটিন আমেরিকার শীর্ষ নেতাদের নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলির সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক জমায়েত আয়োজন করেছেন। উপস্থিত থাকবেন ব্রাজিলের লুইস ইন্যাসিও লুলা দা সিলভা, কলম্বিয়ার গুস্তাভো পেত্রো ও চিলির গাব্রিয়েল বোরিচ। মার্কিন প্রশাসন এ উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখছে; প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথের মতে, পশ্চিম গোলার্ধে চীনা তৎপরতা “সামরিক সুবিধা ও অবৈধ অর্থনৈতিক লাভ” অর্জনের কৌশল।
যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ ও সীমাবদ্ধতা
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত মেক্সিকো ও প্যানামা খালে চীনা সম্পৃক্ততা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে সাম্প্রতিক দশকে দক্ষিণ আমেরিকায় যে বিপুল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বেড়েছে, তা ওয়াশিংটনের পর্যাপ্ত দৃষ্টি পায়নি।
বাণিজ্যচিত্র বদলের দশক
২০১৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল যুক্তরাষ্ট্র—মোট পণ্য বাণিজ্য ২৮০ শতাশ কোটি ডলারের সমতুল্য। ২০২৩ সালে সেই অঙ্ক ২৫ ভাগ কমে যায়, বিপরীতে চীনের বাণিজ্য ৪৩ ভাগ বেড়ে ৩০৪ শতাশ কোটি ডলারে পৌঁছায়। এখন কেবল কলম্বিয়া ও ইকুয়েডরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশি বাণিজ্য করে, তবে সেখানেও চীনের অংশ দ্রুত বাড়ছে।
কাঁচামাল থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি
চিলি থেকে চীনে তামা আকরের রপ্তানি প্রায় তিন গুণ, ব্রাজিল থেকে সয়াবিনের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। একইসঙ্গে চীনা রপ্তানিতে বৈদ্যুতিক যান, সৌর প্যানেলসহ জটিল পণ্য বাড়ছে।
বিনিয়োগ ও ঋণের বলয়
২০০০ থেকে চীনা সংস্থাগুলো দক্ষিণ আমেরিকায় ১৬৮ শতাশ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে—এককভাবে ব্রাজিল পেয়েছে সিংহভাগ। খনি ও কৃষির পাশাপাশি টেলিকম, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ও ইউটিলিটিতেও চীনা সম্পৃক্ততা বাড়ছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিনিয়োগ কমেছে, ২০২৩ সালে ঘোষিত নতুন প্রকল্পের মূল্য আবার বাড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি ২০০৫ থেকে ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ও আর্জেন্টিনায় ১১১ শতাশ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চীন; দেনা অনেকটাই রয়ে গেছে।
জনমত জরিপ: সম্মান ও নির্ভরযোগ্যতার চিত্র
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রিমাইস পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপে ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় সামান্য বেশি ইতিবাচক হলেও, ৬০–৭০ ভাগই মনে করেন তাদের দেশে চীনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সব দেশেই উত্তরদাতারা বলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি সম্মান দেখায় এবং বাণিজ্যে বেশি স্বচ্ছ।
শুল্ক যুদ্ধ ও দ্বিধাহীনতা
ট্রাম্প প্রশাসনের ট্যারিফ চাপ একটি “পছন্দের” পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইলেও দক্ষিণ আমেরিকার নেতারা স্পষ্ট—যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক চায়। লুলা ও বোরিচের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এই অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছে। বেজিং বৈঠকে উঁচু শুল্কের নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতির সম্ভাবনাও আছে।
সামরিক উদ্বেগ ও মহাকাশ সংযোগ
চীনের কোনও সামরিক ঘাঁটি পশ্চিম গোলার্ধে নেই, তবে পেরুর চানকাই বন্দরের মতো বাণিজ্যিক স্থাপনাকে ভবিষ্যতে নৌঘাঁটি হওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত। একইসঙ্গে আর্জেন্টিনার দক্ষিণে চীনা পরিচালিত মহাকাশ গ্রাউন্ড স্টেশন ও চিলিতে প্রস্তাবিত নতুন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা চলছে। কিছু দেশ মার্কিন সরঞ্জাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিকল্প গোয়েন্দা ও অস্ত্রব্যবস্থা ভাবছে।
মার্কিন কূটনীতির ‘স্টিক’ নীতি
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন বহিষ্কার, শুল্ক ও হুমকি শিরোনাম দখল করে আছে; বিনিময়ে অর্থনৈতিক প্রণোদনা নেই বললেই চলে। ইউএসএআইডি বাজেট ছাঁটাইও সফট পাওয়ার ক্ষুণ্ন করেছে।
আর্জেন্টিনার বাস্তববাদী অবস্থান
মার্কিনপন্থী প্রেসিডেন্ট হাবিয়ার মিলেই পর্যন্ত পাঁচ শতাশ কোটি ডলারের চীন-আর্জেন্টিনা মুদ্রা বিনিময় চুক্তি নবায়ন করেছেন, কারণ “আর্জেন্টিনার কল্যাণের জন্য চীনের বাজার জরুরি”—এ কথা তিনিই বলেছেন। জরিপে ৫৬ ভাগ আর্জেন্টাইন এই অবস্থানকে সমর্থন করেছেন।
বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থায় নতুন সমীকরণ
চীনের ব্যবসা ও ঋণ দক্ষিণ আমেরিকায় প্রভাব জোরালো করছে, আর মার্কিন ‘কঠোর’ কৌশল অঞ্চলটিকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। যদিও চীনা দ্রব্যের ডাম্পিং ও কিছু চুক্তি বিতর্ক উসকে দেয়, মার্কিন সংস্কৃতির নরম শক্তি এখনো প্রভাবশালী। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি বিস্তৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও সম্মানজনক আচরণ না দেখায়, দক্ষিণ আমেরিকা দ্রুতই বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থায় চীনের দিকে ঝুঁকতে থাকবে।