০৫:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

আইএমএফ এর কমবে বিদ্যুৎ-এ ভর্তুকি, সমস্যায় পড়বে ভোক্তা ও শিল্প

  • Sarakhon Report
  • ০৪:৪৬:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • 52

সারাক্ষণ রিপোর্ট

ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্তে বিদ্যুৎ সাশ্রয় নয়বাড়তি চাপ

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ বড় কারণ হলেও, এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ জনগণ ও শিল্প খাতে।

বিদ্যুৎ বিল বাড়বেভোগান্তিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত

বর্তমানে সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনছে গড়ে ১০ থেকে ১৪ টাকা দামে এবং তা ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছে ৬ থেকে ৮ টাকায়। এই ব্যবধান ভর্তুকির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। কিন্তু ভর্তুকি কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যবধান ঘুচাতে বাড়ানো হবে বিদ্যুৎ মূল্য।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিল বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার। যারা ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তাদের জন্য মাসিক বিদ্যুৎ বিলের বাড়তি চাপ দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

শিল্প উৎপাদনে ব্যয় বাড়বেপ্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে দেশীয় পণ্য

বিদ্যুৎ খরচ বাংলাদেশের গার্মেন্টস, সিরামিকস, কাগজ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন উৎপাদন খাতের জন্য প্রধান ইনপুট ব্যয়। বিদ্যুৎ খরচ বাড়লে একদিকে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।

বিশেষত, তৈরি পোশাক খাত যেটি দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস, সেখানে ইউনিট খরচের সামান্য পরিবর্তনও বড় অর্ডার হারানোর কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “যদি বিদ্যুৎ ব্যয় ১০ শতাংশও বেড়ে যায়, তাহলে অনেক ছোট-মাঝারি গার্মেন্টস কারখানা টিকে থাকতে পারবে না।”

ক্ষুদ্র শিল্প ও খুচরা ব্যবসার টিকে থাকা কঠিন হবে

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান (এসএমই) গুলোকে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকিয়ে রাখতে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ বাড়লে এই খাতটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি, গ্রামাঞ্চলের দোকান, মেকানিক গ্যারেজ বা ঠান্ডা সংরক্ষণের ছোট ইউনিটগুলো বিদ্যুতের দামে পরিবর্তন হলে বিপদে পড়বে।

জরুরি সেবাতেও প্রভাব পড়ার আশঙ্কা

বিদ্যুৎ খরচ বাড়লে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার মতো জরুরি সেবাতেও ব্যয় বাড়বে। এর প্রভাব পরোক্ষভাবে সাধারণ নাগরিকদের জীবনমানেও পড়বে।

বিশ্লেষকদের মত: দরকার ধাপে ধাপে সমন্বয় ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা

অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ হোসেন বলেন, “ভর্তুকি হ্রাস অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যৌক্তিক হলেও, এর বাস্তবায়ন হতে হবে পরিকল্পিতভাবে। নইলে স্বল্প আয়ের মানুষ ও শ্রমনির্ভর খাতের জন্য এটি ভয়াবহ হবে।”

তিনি আরও বলেন, “সরকার যদি বিদ্যুৎমূল্য বাড়ায়, তাহলে দরিদ্র পরিবার ও কৌশলগত শিল্প খাতের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করা উচিত।”

সরকারের অবস্থান ও সম্ভাব্য সমাধান

সরকার বলছে, ধাপে ধাপে বিদ্যুৎমূল্য সমন্বয় করা হবে এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যেন জনগণ হঠাৎ করে চাপে না পড়ে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ, সিস্টেম লস হ্রাস এবং গ্রিড ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে এসব উদ্যোগের সুফল আসতে সময় লাগবে, এবং ততদিন পর্যন্ত জনগণকে বাড়তি ব্যয় বহন করতে হবে—এমনটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ ভর্তুকি হ্রাস এক অর্থনৈতিক বাস্তবতাকিন্তু সামাজিক চাপও অনস্বীকার্য

বাজেট ঘাটতি কমাতে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হ্রাস একটি বাস্তবিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথ যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা না করে নেওয়া হয়, তাহলে তা দেশের উৎপাদন খাত, কর্মসংস্থান এবং ভোক্তাদের জীবনমান—সবকিছুকেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

সরকারের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো—অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং একইসঙ্গে জনজীবনের চাপ সহনীয় রাখা।

আইএমএফ এর কমবে বিদ্যুৎ-এ ভর্তুকি, সমস্যায় পড়বে ভোক্তা ও শিল্প

০৪:৪৬:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্তে বিদ্যুৎ সাশ্রয় নয়বাড়তি চাপ

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ বড় কারণ হলেও, এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ জনগণ ও শিল্প খাতে।

বিদ্যুৎ বিল বাড়বেভোগান্তিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত

বর্তমানে সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনছে গড়ে ১০ থেকে ১৪ টাকা দামে এবং তা ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছে ৬ থেকে ৮ টাকায়। এই ব্যবধান ভর্তুকির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। কিন্তু ভর্তুকি কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যবধান ঘুচাতে বাড়ানো হবে বিদ্যুৎ মূল্য।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিল বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার। যারা ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তাদের জন্য মাসিক বিদ্যুৎ বিলের বাড়তি চাপ দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।

শিল্প উৎপাদনে ব্যয় বাড়বেপ্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে দেশীয় পণ্য

বিদ্যুৎ খরচ বাংলাদেশের গার্মেন্টস, সিরামিকস, কাগজ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন উৎপাদন খাতের জন্য প্রধান ইনপুট ব্যয়। বিদ্যুৎ খরচ বাড়লে একদিকে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।

বিশেষত, তৈরি পোশাক খাত যেটি দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস, সেখানে ইউনিট খরচের সামান্য পরিবর্তনও বড় অর্ডার হারানোর কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “যদি বিদ্যুৎ ব্যয় ১০ শতাংশও বেড়ে যায়, তাহলে অনেক ছোট-মাঝারি গার্মেন্টস কারখানা টিকে থাকতে পারবে না।”

ক্ষুদ্র শিল্প ও খুচরা ব্যবসার টিকে থাকা কঠিন হবে

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান (এসএমই) গুলোকে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকিয়ে রাখতে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ বাড়লে এই খাতটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি, গ্রামাঞ্চলের দোকান, মেকানিক গ্যারেজ বা ঠান্ডা সংরক্ষণের ছোট ইউনিটগুলো বিদ্যুতের দামে পরিবর্তন হলে বিপদে পড়বে।

জরুরি সেবাতেও প্রভাব পড়ার আশঙ্কা

বিদ্যুৎ খরচ বাড়লে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার মতো জরুরি সেবাতেও ব্যয় বাড়বে। এর প্রভাব পরোক্ষভাবে সাধারণ নাগরিকদের জীবনমানেও পড়বে।

বিশ্লেষকদের মত: দরকার ধাপে ধাপে সমন্বয় ও লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা

অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ হোসেন বলেন, “ভর্তুকি হ্রাস অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যৌক্তিক হলেও, এর বাস্তবায়ন হতে হবে পরিকল্পিতভাবে। নইলে স্বল্প আয়ের মানুষ ও শ্রমনির্ভর খাতের জন্য এটি ভয়াবহ হবে।”

তিনি আরও বলেন, “সরকার যদি বিদ্যুৎমূল্য বাড়ায়, তাহলে দরিদ্র পরিবার ও কৌশলগত শিল্প খাতের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত করা উচিত।”

সরকারের অবস্থান ও সম্ভাব্য সমাধান

সরকার বলছে, ধাপে ধাপে বিদ্যুৎমূল্য সমন্বয় করা হবে এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যেন জনগণ হঠাৎ করে চাপে না পড়ে। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ, সিস্টেম লস হ্রাস এবং গ্রিড ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে এসব উদ্যোগের সুফল আসতে সময় লাগবে, এবং ততদিন পর্যন্ত জনগণকে বাড়তি ব্যয় বহন করতে হবে—এমনটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ ভর্তুকি হ্রাস এক অর্থনৈতিক বাস্তবতাকিন্তু সামাজিক চাপও অনস্বীকার্য

বাজেট ঘাটতি কমাতে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হ্রাস একটি বাস্তবিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথ যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনা না করে নেওয়া হয়, তাহলে তা দেশের উৎপাদন খাত, কর্মসংস্থান এবং ভোক্তাদের জীবনমান—সবকিছুকেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

সরকারের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো—অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং একইসঙ্গে জনজীবনের চাপ সহনীয় রাখা।