সারাক্ষণ রিপোর্ট
উপেক্ষিত ভাষা, দমন হওয়া সংস্কৃতি
পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল হিসেবে, কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই অঞ্চল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। এখানকার জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল বাংলা, তাদের সাহিত্য, সংগীত, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনদর্শন ছিল স্বতন্ত্র ও গভীরভাবে শিকড়ে প্রোথিত।
কিন্তু ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন। এই সিদ্ধান্ত বাঙালিদের স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক পরিচিতিকে অস্বীকার করার সমান ছিল।
ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশের প্রথম প্রত্যক্ষ চিহ্ন। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, বাংলা ভাষা শুধু কথ্য ভাষা নয়, এটি একটি আত্মপরিচয়ের প্রতীক। আন্দোলনের সময় প্রচুর দেশপ্রেমমূলক কবিতা, গান, নাটক ও দেয়ালচিত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময় থেকেই বাঙালি সংস্কৃতি ক্রমশ রাষ্ট্রীয় দমননীতি প্রতিহত করে উঠে দাঁড়াতে শুরু করে।
‘আমার সোনার বাংলা‘: এক জাতির গান
এই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মিক চেতনার প্রতীক। গানটি মূলত ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় লেখা হয়েছিল। তখন এটি ছিল বাংলার ঐক্য ও ভালোবাসার গান। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সময় এই গানটি নতুন মাত্রা পায়।
গানটি গাইলে মানুষ মনে করত, “আমরা বাঙালি, আমাদের ভাষা বাংলা, আমাদের মাটি এই পূর্ব বাংলা।” এটি ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া উর্দুভাষার বিরুদ্ধে এক নীরব কিন্তু প্রগাঢ় প্রতিবাদ।
গান থেকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে “আমার সোনার বাংলা” হয়ে ওঠে স্বাধীনতার প্রতীক। মুক্তিযোদ্ধারা এই গান গেয়ে অনুপ্রাণিত হতেন, সাধারণ মানুষ এই গান গেয়ে দুঃসহ সময়ে আশার আলো খুঁজে পেতেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এই গানটিকেই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক সংগ্রাম
পূর্ব পাকিস্তানে ছায়ানট ছিল একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাঙালি সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রসারে বিপ্লবাত্মক ভূমিকা পালনকারী সংগঠন। ধর্মীয় বিভাজন এবং সংস্কৃতিগত দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছায়ানট রবীন্দ্রসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত এবং আবহমান বাঙালি ঐতিহ্যকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৬৭ সালে ঢাকার রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু করে ছায়ানট, যা পরবর্তীতে এক জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের রূপ নেয়। তাদের অনুষ্ঠানে বার বার গাওয়া হতো, আমার সোনার বাংলা তেমনি ছাত্র ইউনিয়ন সহ ওই সময়ের বড় ও জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে “ আমার সোনার বাংলা” গানটি এক প্রকার তাদের আত্মার সঙ্গে মিশিয়ে নেয়।
অন্যদিকে উদিচি গন সঙ্গীত ভিত্তিক সংগঠন হলেও তাদের অনুষ্ঠানেও তারা নানান সময়ে গাইতো “ আমার সোনার বাংলা” ।
সব মিলে “আমার সোনার বাংলা” শুধু একটি গান নয়, এটি একটি চেতনা, একটি আন্দোলনের ভাষা, একটি জাতির আত্ম-ঘোষণা। পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া এই সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানই বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণে গভীর ভূমিকা রেখেছে।
এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে না পারলে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড় হারাবো। আর সেই শিকড়ের মধ্যেই রয়েছে আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয় ও গর্ব।