আহমদ মওদুদ আউসাফ
“সুয়োমোটু সুবিধা আর নাও থাকতে পারে,” মন্তব্য করলেন বিচারপতি আমিন-উদ-দিন খান। কথাটি উচ্চারিত হলো নিস্তরঙ্গ স্বরে—আশঙ্কা নয়, বরং একটি যুগকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে দেখার স্বাভাবিক স্থৈর্যে।
কিন্তু এই মন্তব্য আসলে যা ইঙ্গিত করে তা কোনো প্রক্রিয়াগত নম্রতা বা গণতান্ত্রিক পরিপক্বতা নয়; এটি এক শীতল, ইচ্ছাকৃত পশ্চাদপসরণ। যে বিচারব্যবস্থাকে একসময় অধিকারের শেষ প্রহরী বলে ভাবা হতো, সেটিই এখন যেন চাদর গুটিয়ে, হাত জোড় করে বসে অপেক্ষা করছে।
ভুলে গেলে চলবে না—সংবিধানের ১৮৪(৩) অনুচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছিল ক্ষমতাবানদের জন্য নয়, বেঞ্চের খেয়ালের জন্যও নয়। এটি ছিল গুম হওয়া, উচ্ছেদ-করা, ভোটাধিকারবঞ্চিত অসহায় মানুষের কণ্ঠস্বর, যখন তাদের আর চিৎকারের শক্তি থাকে না। অন্য কেউ এগোতে না চাইলে, আদালত পারত। সুয়োমোটুর নৈতিক স্থাপত্য ছিল এটাই।
হ্যাঁ, এর সংস্কার দরকার ছিল। সুয়োমোটু কখনও স্বেচ্ছাচারী, কখনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, প্রায়শই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এর সমাধান ছিল সংস্কার, পরিত্যাগ নয়। গ্রহণের মানদণ্ড নির্ধারণ করুন, কারণ দেখিয়ে নোটিশ নিন, আপিলের নজরদারি রাখুন—কিন্তু আমাদের সাংবিধানিক ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক ক্ষমতাকে নীরবে ‘ইউথেনাইজ’ করতে দেবেন না।
এই প্রতিষ্ঠানিক অচেতনতা এক দিনে আসেনি। এটি এসেছে ধীর, দফতরি গতিতে, ‘সংস্কার’ নামের মখমলি মোড়কে। ২০২৩ সালের সুপ্রিম কোর্ট প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রোসিডিওর আইন প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা সীমিত করে, প্রধান বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতিকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে এবং আপিলের অধিকার দেয়। গত বছর ২৬তম সংবিধান সংশোধনী, ‘সন্তুলনের পদক্ষেপ’ নামে পরিচিত, কেবল দ্বিধাকে আইনি ব্যাকরণে ঢেলে দিল।
ফলে বিচারালয়ে এখন স্পষ্টতা আর কোনো গুণ নয়। বিচারপতি মোহাম্মদ আলী মাজহার বলেছেন, সুয়োমোটু যেহেতু সাংবিধানিক বিধান, তাই এটি এখন সাংবিধানিক বেঞ্চের মাধ্যমেই প্রয়োগ করতে হবে।
২৬তম সংশোধনী স্পষ্টভাবে বলছে, সাংবিধানিক বেঞ্চই মূল বিচারিক এখতিয়ার প্রয়োগ করবে; তবু নকশায় নিহিত রয়েছে একটি কাল্পনিক ঝুঁকি। আগে করা সংশোধনের একই পদ্ধতি কি এখানেও বহাল থাকবে?
এখন কি শুধুমাত্র সাংবিধানিক বেঞ্চের প্রধানের অনুমতিতেই এটি প্রয়োগ হবে? আর পদ্ধতি এত পরিষ্কারই যদি হয়, তা হলে বিচারপতি আমিন-উদ-দিন খান কেন এ মন্তব্য করতে বাধ্য হলেন? ২৬তম সংশোধনী裁েচ্ছাশক্তি সীমিত করতে গিয়ে তৈরি করেছে এখতিয়ারি দ্বন্দ্ব—অধিকার আছে, কিন্তু ব্যবহার করার উপায় অনিশ্চিত।
যখন কেউই এগোতে চাইত না, আদালত পারত।
এই নিদ্রাচার যদি এখন মতবাদের স্বীকৃতি পায়, তবে স্মরণ করুন—আমরা কোন পথ হারিয়ে ফেলেছি।
‘দর্শন মাসীহ বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় আদালত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে স্বীকার করেছিল, আনুষ্ঠানিক আবেদন না থাকলেও সংবিধান কাজ চাইতে পারে। তখন আদালত—অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ—তবু উঁচু হয়েই দাঁড়িয়েছিল।
আজ ব্যাখ্যার স্রোত ভেতরের দিকে গুটিয়ে নিয়েছে। আমাদের শেখানো হচ্ছে—সংযম গুণ, নিরপেক্ষতা মহত্ত্ব। কিন্তু যখন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, ভিন্নমত উধাও হয়, আইন অস্ত্রে পরিণত হয়, নিরপেক্ষতা পরিণত হয় সহযোগিতায়।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যত্র চিত্র ভিন্ন। ভারতে সংবিধানের ৩২ ও ২২৬ অনুচ্ছেদ আদালতকে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই রিট জারি করতে ক্ষমতায়ন করেছে। বাংলাদেশে, যেখানে সুয়োমোটুর স্পষ্ট অনুমতি নেই, আদালত ‘সাংবিধানিক প্রতিস্থাপন’ নাম দিয়ে নিজের পথ তৈরি করেছে, অনুপ্রেরণা ভারতের জনস্বার্থ মামলা ব্যবস্থায়।
দুটি দেশই আদালতের নৈতিক পাঠ গ্রহণ করেছে—বিচারকে প্রক্রিয়াগত অচলাবস্থার জিম্মি হতে দেয়নি। পথ টানা-পোড়েনের, কখনও অপব্যবহৃত, কিন্তু কখনও স্তব্ধ নয়। পাকিস্তান ইতোমধ্যে নিয়মবদ্ধ করেছে সতর্কতা।
এটি বিচারিক কর্মতৎপর্যের রোমান্টিকরণ নয়; কেবল বলা—অধিকার সম্মতির অপেক্ষা করতে পারে না।
তাত্ত্বিক দিকেও সুয়োমোটু বরাবরই নির্বাহী কর্তৃত্বকে লাগাম পরাতে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই যদি যুক্তিসঙ্গত বাউন্ডারির মধ্যে নিয়ন্ত্রিত বিচারিক সক্রিয়তা থাকে, অধিকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সংঘাত থাকে না; বরং তা সৌন্দর্য বাড়ায়।
বিচারপতি আমিন-উদ-দিন যা বলেছেন, আর আদালত যা অনুমোদনের ঝুঁকিতে আছে, তা শুধু আইনগত পশ্চাদপসরণ নয়, মানবিকও। এটি নিঃস্বদের বলে—তাদের শেষ আশ্রয় আদালতও নীরবে বোর্ড টাঙিয়েছে: ‘পরে আসুন’।
কিন্তু ইতিহাস অপেক্ষা করে না, নজর রাখে। একদিন প্রশ্ন করবে—আদালত কেন, তার আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞায়, সেই একমাত্র ক্ষমতা ছেড়ে দিল, যা নাগরিক ও দানবীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের মাঝখানে তাকে দাঁড় করিয়েছিল? রায় নির্ধারণ করতে নয়, নীতি বানাতে নয়—শুধু সংবিধান যখন কাঁদত, কেউ যেন শোনে তা নিশ্চিত করতে।
এই নীরবতাকে প্রজ্ঞা ভাবা চলবে না। এর নাম দিতে হবে—দায়বিমুখতা।
লেখক আইনজীবী।প্রকাশিত: ডন, ১৪ মে ২০২৫