সারাক্ষণ রিপোর্ট
ঢাকা, ১৫ মে ২০২৫ —
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে নিয়ন্ত্রিত ভাসমান বিনিময় হার চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে মার্কিন ডলার লেনদেন করতে পারবে, যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গোপনে নির্ধারিত একটি ব্যান্ডের মধ্যেই হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখবে। IMF-এর চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির তহবিল ছাড়ের শর্ত হিসেবে এই সংস্কার বাস্তবায়ন হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ব্যাংক খাত, আমদানি-রপ্তানি খাত এবং অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া, পাশাপাশি সম্ভাব্য ঝুঁকি ও করণীয় নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন:
ব্যাংক খাতের প্রতিক্রিয়া: ‘নেতিবাচক মনোবল‘ থেকে সাবধানবার্তা
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (BAB)-এর সভাপতি সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, “ভাসমান বিনিময় হার বাজারের বাস্তবতা প্রতিফলন করবে, এতে স্বচ্ছতা বাড়বে। তবে প্রথম দিকে কিছুটা অস্থিরতা দেখা যেতে পারে।”
তবে কিছু ব্যাংকার সতর্ক করছেন যে রিজার্ভ যদি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি পর্যাপ্ত হস্তক্ষেপ না করতে পারে, তাহলে বাজারে ‘স্পেকুলেটিভ ট্রেডিং’ বাড়তে পারে, যা ক্ষুদ্র আমদানিকারকদের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।
রপ্তানিকারকদের প্রতিক্রিয়া: ‘অবশেষে একটি আশার আলো‘
রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএ-র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “রপ্তানিকারকরা অনেক দিন ধরেই বাস্তব রেট চেয়ে আসছেন। এটি আমাদের আয়ের টাকায় যথাযথ রূপান্তরের সুযোগ এনে দেবে।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “এটা যেন আবার আমদানিকারকদের জন্য ঝুঁকি না হয়ে দাঁড়ায়, সেই দিকেও নজর দিতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ যেন আগেই বাজার মনিটর করে হস্তক্ষেপ করে।”
রেমিট্যান্স প্রেরকদের পক্ষ থেকেও স্বস্তির সুর এসেছে। হুন্ডির চাপে থাকা বাজারে যদি ব্যাংক রেট বাস্তবের কাছাকাছি হয়, তবে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ব্যাংকিং চ্যানেলে বাড়বে বলে তারা মনে করেন।
আমদানিকারকদের উদ্বেগ: ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (DCCI)-এর সভাপতি আশরাফুল হক বলেন, “ডলারের দর যদি হঠাৎ বেড়ে যায়, তাহলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে, যা মূল্যস্ফীতিতে চাপ দেবে। এই রূপান্তর ধাপে ধাপে হলে ভালো হতো।”
বিশেষত খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে, কারণ এসব খাতে ডলার দরবৃদ্ধি মানে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়া।
অর্থনীতিবিদদের আগাম সতর্কতা: বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা জরুরি
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান (সিপিডি) বলেন, “নীতিগত দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি দ্বৈত নীতি (ডিক্লেয়ারড রেট বনাম প্র্যাকটিকাল রেট) থেকে না সরা যায়, তাহলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।”
তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বচ্ছভাবে বাজারে প্রবেশ ও প্রস্থান করতে হবে, যেন বাজারে বার্তা যায়—ডলার হঠাৎ করে উর্ধ্বমুখী হলে ব্যাংক বসে থাকবে না।”
পরিবর্তনের পথ কাঁটাযুক্ত, কিন্তু অপরিহার্য
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে, দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে। তবে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, বাজার মনিটরিং দক্ষতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা—এই তিনটি বিষয়ে ঘাটতি থাকলে পরিস্থিতি অস্থির হয়ে পড়তে পারে।
ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তাবনা:
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজারে হস্তক্ষেপের একটি স্বচ্ছ পদ্ধতি প্রকাশ করা, অন্তত মূলনীতি আকারে।
রপ্তানিকারকদের জন্য ডলার রপ্তানি আয়ের দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা।
আমদানিকারকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এলসি সুবিধা ও হেজিং পদ্ধতি চালু করা।
স্পেকুলেটিভ কারসাজির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
সর্বোপরি বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি মোড় ঘোরানো পর্বে আছে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হওয়ার মাধ্যমে যে ইতিবাচক বার্তা গেছে, তা বাস্তবে প্রতিফলিত করার দায়িত্ব এখন নীতিনির্ধারক ও বাজার অংশগ্রহণকারীদের।
এই সিদ্ধান্ত যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে, তেমনি ত্রুটিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে তার চড়া মাশুল দিতে হতে পারে। তাই সময়মতো বাজার তদারকি, দ্রুত প্রতিক্রিয়া, এবং ব্যাংক-রপ্তানিকারক-আমদানিকারক—তিনপক্ষের সুষম সমন্বয়ের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।