আর্কাদি গাইদার
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমায় দেখতে পেয়ে শেবালভ বললেন, ‘দাঁড়াও। তোমারে এখেনেই থাকতি হবে। তুমি বরং, বাড়ির চালে চুবুকের কাচে চলি যাও। ওখেন থেকে চুবুক যা দেখবে তা একছুটে জঙ্গলের ধারে গিয়ে আমারে জানিয়ে আসবে। আর ওরে বোলো, ডানদিকি খামুর রোডের ওপরও যেন লজর রাখে। কওয়া তো যায় না, ওদিক থেকেও কিছু এসে পড়তি পারে।’
এক, দুই, ক্লিঙ্ক-ক্লিঙ্ক… অলসভাবে রোদ পোহাতে-পোহাতে একটা হাঁস উঠল প্যাঁকপ্যাঁক করে। ল্যাজে গাড়ির-চাকার-তেলকালি-মাখা আগুন-রঙা একটা মোরগ বেড়ার ওপরে বসে হঠাৎ বিজয়ীর মতো ডাক ছাড়তে লাগল, কোঁকর-কোঁ। তারপর সজোরে পাখা ঝাপ্টাতে-ঝাপ্টাতে মোরগটা যখন নিচের ধুলোমাখা আগাছাগুলোর ওপর পড়ে চুপ করে গেল, তখন সারা খামারটা গেল আবার একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে। চারিদিক এত স্তব্ধ হয়ে গেল যে বহুদূর শূন্য থেকে ভেসে আসতে লাগল ভরতপাখির খুশিভরা ডাক আর ফুলে-ফুলে উষ্ণ, মিষ্টি গন্ধে-ভরা ফোঁটা-ফোঁটা মধু সংগ্রহে-ব্যস্ত মৌমাছির একটানা গুন্গুনি।
আমি যখন খামারবাড়ির খড়ে-ছাওয়া চালে উঠলুম তখন চুবুক মাথা না-ফিরিয়েই বললেন, ‘ব্যাপারটা কী?’
‘শেবালভ আপনাকে সাহায্য করার জন্যে আমায় পাঠালেন।’
‘ঠিক আচে। বসি থাক চুপচাপ। লিজে থেকে দেখা দিও না কিন্তু।’
শেবালভের নির্দেশ আমি জানিয়ে দিলুম চুবুককে, ‘ডান দিকটায় একটু চোখ রাখবেন। খামুর রোডের ওপর যদি কিছু দেখা যায়, সেই জন্যে।’
যেখেনে আচ, চুপটি করে বসি থাক, উনি সংক্ষেপে জবাব দিলেন। তারপর মাথা থেকে টুপিটা খুলে প্রকাণ্ড বড় মাথাটা চিমনির পেছন থেকে অল্প-একটু বের করে দেখতে লাগলেন।
কিন্তু কোথাও তখনও পর্যন্ত শত্রুর সেনাবাহিনীর দেখা নেই। বোঝা গেল, ওরা একটা খাদের আড়ালে আছে, আর যে-কোনো মুহূর্তে ফের দেখা দিতে পারে।
চালের ওপর খড়গুলো পেছল থাকায় পাছে হড়কে নিচে নেমে যাই এই ভয়ে নড়াচড়া না-করে চুপচাপ বসে রইলুম আমি, আর পায়ের আঙুলগুলো খড়ের মধ্যে গজে দিয়ে পা আটকে রাখার একটা জায়গা করে নিলুম। চুবুকের মাথা আর আমার মুখ প্রায় ছাঁই-ছাই করছিল। সেই প্রথম আমি লক্ষ্য করলুম, ওঁর কুচকুচে কালো মোটা-মোটা চুলের ফাঁকে শাদার ডোরা দেখা দিয়েছে। অবাক হয়ে ভাবলুম, ‘আচ্ছা, চুবুক কি তাহলে বুড়ো হয়ে গেছেন?’