আর্কাদি গাইদার
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
‘তাই তো দেখচি,’ এমন সূরে উত্তর দিলেন শেবালভ যে মনে হল কোনো কারণে বুঝি আমি ওঁকে চটিয়ে দিয়েছি। বললেন, ‘লিজেই দেখতে পাচ্চি আমি।’
বুঝলুম, শত্রুর সৈন্য সাজানোর এই অপ্রত্যাশিত কৌশল দেখে ওঁর মেজাজটা শুধু খিচড়ে গেছে, আর কিছুই নয়।
‘ফেরত যাও, আর আসতি হবে না। ওদের পাশের দিকি আর খামুর রোডের দিকি কড়া নজর রাখো।’
খামারবাড়ির ফাঁকা উঠোনে একছুটে ঢুকে ঘরের চালে ওঠার জন্যে শুকনো ডালপালা-দিয়ে-বাঁধা বেড়ার ওপর উঠলুম।
হঠাৎ একটা ফিসফিসে গলায় কথা শোনা গেল, ‘সেপাই-ছেলে! অ সেপাই-ছেলে!’
চমকে উঠে আমি পেছন ফিরে তাকালুম। আওয়াজটা ঠিক কোথেকে আসছে বুঝতে পারলুম না।
ফের সেই গলা শোনা গেল, ‘অ সেপাই-ছেলে!’
এবার লক্ষ্য করলুম উঠোনের ওপর মাটির নিচের ভাঁড়ার-ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা আর তার ভেতর থেকে একটি মেয়েছেলে মাথা বের করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েছেলেটি হল চাষীরই বৌ।
ফিসফিস করে এবার তিনি বললেন, ‘ওরা কি আসতিছে?’
আমিও ফিসফিস করে বললুম, ‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, কও তো, ওদের সাথে কি কামানও আছে, নাকি খালি মেশিনগান?’ তাড়াতাড়ি নিজের গায়ে ক্রুশচিহ্ন এ’কে মেয়েছেলেটি শুধোলেন, ‘ভগমান করুন ওদের সাথে যেন শুধু মেশিনগান থাকে, নইলে এখেনে সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করি দেবে!’
আমি ওঁর কথার উত্তর দেবার আগেই একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল আর একটা অদৃশ্য বুলেট সজোরে তীক্ষ্য একটা ‘পি-ইং’ আওয়াজে শিস দিয়ে আকাশের দিকে কোথায় যেন উড়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েছেলেটির মাথা গেল অদৃশ্য হয়ে আর ভাঁড়ারঘরের দরজা বন্ধ হল দড়াম করে। ভাবলুম, ‘এই শুরু হতে চলেছে’। যুদ্ধ শুরু হবার মুখে-অর্থাৎ, দমকে-দমকে মেশিনগানের ক্রুদ্ধ চটাপট্ শব্দের ফোয়ারা আর থেকে-থেকে কামানগুলোর গুরুগম্ভীর গর্জনসহ রীতিমতো আক্রমণ আর গোলাগুলি-বর্ষণ শুরু, হয়ে যায় যখন তখন নয়, আসলে যখন কোনো কিছুই শুরু হয় নি কিন্তু সত্যিকার বিপদ ঘটতে চলেছে, তখনই যে-যন্ত্রণাকর উত্তেজনা মানুষকে পেয়ে বসে, সেইরকম একটা অনুভূতি আমাকে তখন আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। অন্য সকলের মতো আমারও মনে হচ্ছিল, ‘চারিদিক এত চুপচাপ কেন? এত দেরি হচ্ছে কেন ব্যাপারটা ঘটতে? এর চেয়ে যা হবার হয়ে যাক-না তাড়াতাড়ি!’