০৯:১২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫

ছোট এক টুকরো গোশতের স্বপ্ন

  • Sarakhon Report
  • ০৬:১৫:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
  • 113

সারাক্ষণ রিপোর্ট

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে জীবন কাটান লাখো মানুষ। ঘামে ভেজা সেই জীবনের একটুকরো স্বপ্ন—গোশত। হ্যাঁ, মাসে একবার গরু বা খাসির মাংস খাওয়া এখনো বহু রিকশাচালকের কাছে বিলাসিতা। এই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে আমরা কথা বলেছি ঢাকার কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে এবং বিশ্লেষণ করেছি বর্তমান খাদ্যব্যয় ও মাংসের বাজারদর।

রাজু মিয়ার স্বপ্ন: বাচ্চাদের মুখে হাসি দেখতেই ভালো লাগে

মুগদার রাজু মিয়া বলেন, “ছেলেপুলে মাংস খেতে চায়। কিন্তু কীভাবে খাওয়াবো বলেন? বাসা ভাড়া, চাল-ডাল, স্কুল ফি—সব মিলায়া মাস শেষে হাতে কিছুই থাকে না। তাই মাসে একবার কিনি, ৩০০-৩৫০ গ্রাম গরুর মাংস, সেটা দিয়েই একটা দিন সবাইকে খাওয়াই।”

রাজুর পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। মাংসের পরিমাণ যখন এত সীমিত, তখনই রান্নায় বেশি আলু, পেঁপে কিংবা বেগুন দিয়ে ঝোল বাড়িয়ে খাওয়ানো হয়। কিন্তু মন ভরে না—না পরিবারের, না রাজুর।

সোহেলের কণ্ঠে অভিমান: মাংসের গন্ধে ছেলেটা বলে, ‘বাবাআমাদের বাসায় কেন হয় না?’”

মালিবাগের সোহেল ইসলাম, যিনি দিনে গড়ে ৫৫০ টাকা আয় করেন, বলেন, “মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে গেলে আমার ছেলে মাংস চেয়ে বসে। আর আমি চোখ ফিরিয়ে নেই। মাসে একবার জমানো টাকা দিয়ে ২০০ গ্রাম মাংস কিনি। তাও শুধু ছেলের জন্য। আমি নিজে খাই না।”

পরিসংখ্যান কী বলছে?

  • বাংলাদেশ পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (BNNRI) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শহুরে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোতে প্রতি মাসে মাথাপিছু মাংস গ্রহণ মাত্র ১০০-১৫০ গ্রাম, যেখানে WHO-এর সুপারিশ প্রতি মাসে গড়ে ২ কেজি।
  • বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিলে ঢাকায় গরুর মাংসের গড় দাম ৭৫০-৮০০ টাকা/কেজি, খাসির মাংস ১১০০ টাকা/কেজি ছুঁয়েছে। অথচ রিকশাচালকেরা দৈনিক আয় করেন গড়ে ৫০০-৬০০ টাকা।

চিকিৎসকের মতামত: তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে

ঢাকা মেডিকেলের পুষ্টিবিদ ডা. নাসরিন কবির বলেন, “রিকশাচালকদের মতো শ্রমজীবী মানুষের বেশি পরিমাণ প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু নিয়মিত মাংস খেতে না পারায় তারা কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন, ক্লান্তি, রোগপ্রবণতা এবং অস্থিসন্ধি ব্যথার ঝুঁকি বাড়ছে।”

খাবারেই বৈষম্য: আমিষ কার জন্য?

একদিকে শহরের কিছু মানুষ প্রতিদিনের খাবারে তিন বেলার মাংস রাখেন, অন্যদিকে রাজু বা সোহেলদের মতো মানুষ মাসে একদিন মাংস কেনেন সন্তানের হাসির জন্য। এই বৈষম্যই বলে দেয়—খাবারের ক্ষেত্রেও অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রক।

কোনো সমাধান?

বিশেষজ্ঞদের মত—

  • নগর দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি দিয়ে সাশ্রয়ী দামে মাংস বিক্রির ব্যবস্থা নিতে হবে
  • কেজি-প্রতি প্যাকেটজাত ‘আংশিক হাড়বিহীন’ মাংস কমদামে বাজারে আনলে নিম্নআয়ের মানুষও উপকৃত হবেন
  • অস্থায়ী হাটে সরকার ও এনজিও-সমর্থিত আমিষ বিতরণ কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে

শেষ কথায় কিছু হৃদয়ের কথা

একদিন রাজু মিয়ার ছেলে বলেছিল, “বাবা, ঈদের সময় অনেক মাংস খেতে পারি না?” রাজু জবাব দিতে পারেননি। শুধু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “আল্লাহ চাইলে খাওয়ামু।”

এই কথাটাই হয়তো আজকের বাংলাদেশে হাজারো রিকশাচালকের আর্তনাদ—ছোট এক টুকরো গোশতের স্বপ্ন, যার পেছনে লুকিয়ে আছে ভালোবাসা, কষ্ট আর মানবিকতা।

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৪২)

ছোট এক টুকরো গোশতের স্বপ্ন

০৬:১৫:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে জীবন কাটান লাখো মানুষ। ঘামে ভেজা সেই জীবনের একটুকরো স্বপ্ন—গোশত। হ্যাঁ, মাসে একবার গরু বা খাসির মাংস খাওয়া এখনো বহু রিকশাচালকের কাছে বিলাসিতা। এই বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে আমরা কথা বলেছি ঢাকার কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে এবং বিশ্লেষণ করেছি বর্তমান খাদ্যব্যয় ও মাংসের বাজারদর।

রাজু মিয়ার স্বপ্ন: বাচ্চাদের মুখে হাসি দেখতেই ভালো লাগে

মুগদার রাজু মিয়া বলেন, “ছেলেপুলে মাংস খেতে চায়। কিন্তু কীভাবে খাওয়াবো বলেন? বাসা ভাড়া, চাল-ডাল, স্কুল ফি—সব মিলায়া মাস শেষে হাতে কিছুই থাকে না। তাই মাসে একবার কিনি, ৩০০-৩৫০ গ্রাম গরুর মাংস, সেটা দিয়েই একটা দিন সবাইকে খাওয়াই।”

রাজুর পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। মাংসের পরিমাণ যখন এত সীমিত, তখনই রান্নায় বেশি আলু, পেঁপে কিংবা বেগুন দিয়ে ঝোল বাড়িয়ে খাওয়ানো হয়। কিন্তু মন ভরে না—না পরিবারের, না রাজুর।

সোহেলের কণ্ঠে অভিমান: মাংসের গন্ধে ছেলেটা বলে, ‘বাবাআমাদের বাসায় কেন হয় না?’”

মালিবাগের সোহেল ইসলাম, যিনি দিনে গড়ে ৫৫০ টাকা আয় করেন, বলেন, “মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে গেলে আমার ছেলে মাংস চেয়ে বসে। আর আমি চোখ ফিরিয়ে নেই। মাসে একবার জমানো টাকা দিয়ে ২০০ গ্রাম মাংস কিনি। তাও শুধু ছেলের জন্য। আমি নিজে খাই না।”

পরিসংখ্যান কী বলছে?

  • বাংলাদেশ পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (BNNRI) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শহুরে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোতে প্রতি মাসে মাথাপিছু মাংস গ্রহণ মাত্র ১০০-১৫০ গ্রাম, যেখানে WHO-এর সুপারিশ প্রতি মাসে গড়ে ২ কেজি।
  • বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিলে ঢাকায় গরুর মাংসের গড় দাম ৭৫০-৮০০ টাকা/কেজি, খাসির মাংস ১১০০ টাকা/কেজি ছুঁয়েছে। অথচ রিকশাচালকেরা দৈনিক আয় করেন গড়ে ৫০০-৬০০ টাকা।

চিকিৎসকের মতামত: তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে

ঢাকা মেডিকেলের পুষ্টিবিদ ডা. নাসরিন কবির বলেন, “রিকশাচালকদের মতো শ্রমজীবী মানুষের বেশি পরিমাণ প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু নিয়মিত মাংস খেতে না পারায় তারা কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন, ক্লান্তি, রোগপ্রবণতা এবং অস্থিসন্ধি ব্যথার ঝুঁকি বাড়ছে।”

খাবারেই বৈষম্য: আমিষ কার জন্য?

একদিকে শহরের কিছু মানুষ প্রতিদিনের খাবারে তিন বেলার মাংস রাখেন, অন্যদিকে রাজু বা সোহেলদের মতো মানুষ মাসে একদিন মাংস কেনেন সন্তানের হাসির জন্য। এই বৈষম্যই বলে দেয়—খাবারের ক্ষেত্রেও অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রক।

কোনো সমাধান?

বিশেষজ্ঞদের মত—

  • নগর দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি দিয়ে সাশ্রয়ী দামে মাংস বিক্রির ব্যবস্থা নিতে হবে
  • কেজি-প্রতি প্যাকেটজাত ‘আংশিক হাড়বিহীন’ মাংস কমদামে বাজারে আনলে নিম্নআয়ের মানুষও উপকৃত হবেন
  • অস্থায়ী হাটে সরকার ও এনজিও-সমর্থিত আমিষ বিতরণ কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে

শেষ কথায় কিছু হৃদয়ের কথা

একদিন রাজু মিয়ার ছেলে বলেছিল, “বাবা, ঈদের সময় অনেক মাংস খেতে পারি না?” রাজু জবাব দিতে পারেননি। শুধু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “আল্লাহ চাইলে খাওয়ামু।”

এই কথাটাই হয়তো আজকের বাংলাদেশে হাজারো রিকশাচালকের আর্তনাদ—ছোট এক টুকরো গোশতের স্বপ্ন, যার পেছনে লুকিয়ে আছে ভালোবাসা, কষ্ট আর মানবিকতা।