সারাক্ষণ রিপোর্ট
দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রস্তাব
কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান আলিমেন্তাসিওঁ কুশ-তার্দ প্রায় নয় মাস আগে জাপানি খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সেভেন অ্যান্ড আই হোল্ডিংস-এর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেওয়ার জন্য। তবে আলোচনায় টানাপোড়েন এবং মালিক পক্ষের আপাত অনাগ্রহের কারণে প্রশ্ন উঠেছে—এই ৪৭ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবে কুশ-তার্দ কতদিন আগ্রহ ধরে রাখবে।
এই সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আলাঁ বুশারদ—প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং বড় শেয়ারহোল্ডার। বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি হলেও তিনি এখনও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সক্রিয়।
ধৈর্যের মানুষ বুশারদ
বুশারদের জীবনীকার গি জঁদ্রঁ বলেন, “তাঁরা মনে করেন প্রস্তাবটি যথেষ্ট ভালো এবং শেয়ারহোল্ডারদের সামনে তা উপস্থাপন করা উচিত।” ৭-ইলেভেন কিনে নেওয়ার প্রস্তাবটি জাপানে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের করা সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণ প্রস্তাব বলেই বিবেচিত।
বুশারদের ব্যবসায়িক ধৈর্য নিয়ে জঁদ্রঁ বলেন, “তিনি ধাপে ধাপে ব্যবসা বড় করেছেন। বহু দোকানে গিয়ে নিজে দরজায় কড়া নাড়েছেন, অনেক বছর পরেও আবার ফিরেছেন।”
নিভৃতচারী জীবন, সংগ্রামের শিকড়
কানাডার অন্যতম ধনী হলেও বুশারদ খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন। মন্ট্রিয়ালের উত্তরে একই কটেজে পরিবার নিয়ে ৫০ বছর কাটিয়েছেন। ছোট অফিসে কাজ করেন। জীবনের শুরুতে পরিবার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ে; বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়, মা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন, বড় বোন স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন—এই অভিজ্ঞতাগুলো তাঁকে জীবনের প্রতিশোধ নিতে শিখিয়েছে।
৭-ইলেভেন কেনার লক্ষ্য বহুদিনের
বুশারদ জানিয়েছেন, গত ২০ বছর ধরে তিনি সেভেন অ্যান্ড আই নিয়ে আগ্রহী। ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে তিনি তাদের উত্তর আমেরিকান ব্যবসা কিনতে চেয়েছিলেন। ২০২০ সালেও আবার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
মার্চে জাপানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমরা অধিগ্রহণ থেকে পিছু হটছি না।” যদিও তিনি প্রক্রিয়ার ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ করেন।
একটি বড় ঐতিহাসিক সুযোগ
এই অধিগ্রহণ কেবল ব্যবসায়িক নয়, বুশারদের জন্য এটি একটি ব্যক্তিগত চূড়ান্ত সাফল্যের গল্প। ২০২১ সালে ফ্রান্সের কারেফুর কিনতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এটি তার জন্য প্রতিশোধমূলকও বটে।
২০২৪ সালের মে মাসে কুশ-তার্দ জানায়, তারা সেভেন অ্যান্ড আই-এর সঙ্গে একটি অপ্রকাশযোগ্যতা চুক্তি (NDA) স্বাক্ষর করেছে। আগে এই প্রক্রিয়া থমকে ছিল, কারণ কুশ-তার্দ ‘স্ট্যান্ডস্টিল’ শর্তে আপত্তি জানিয়েছিল। পরে উভয়পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছায়।
ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা
বুশারদ বলেন, ছোটবেলায় বাবা তাঁকে ছোট দোকান ও গ্যারেজ পরিদর্শনে নিয়ে যেতেন। “এই দোকানটিকে ব্যবসা হিসেবে চালানো যাবে কিনা, হিসাব করে বলো”—এই প্রশ্ন তাঁকে ভাবতে শেখায়।
কুশ-তার্দ প্রথম দোকান খোলে ১৯৮০ সালে কুইবেকে। ২০০১ সালে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করে বিগফুট স্টোর কিনে, ২০০৩ সালে সার্কেল কে কিনে নেয়। পরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় স্টেটওইল ফুয়েল অ্যান্ড রিটেইল কিনে ইউরোপে প্রবেশ করে। সবক্ষেত্রেই স্থানীয় সংস্কৃতি ও ব্যবস্থাপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছে তারা।
প্রতিযোগিতা ও চ্যালেঞ্জ
৭-ইলেভেনের সঙ্গে কুশ-তার্দের অধিগ্রহণ যুদ্ধ নতুন নয়। ২০১০ সালে দুই প্রতিষ্ঠানই মার্কিন রিটেইল কোম্পানি ‘কেসিজ’ কিনতে চেয়েছিল, তবে ব্যর্থ হয়। ২০২১ সালে সেভেন অ্যান্ড আই ‘স্পিডওয়ে’ কিনে নেয়—সেখানে কুশ-তার্দও বিড করেছিল।
ফ্রান্সের কারেফুর কেনার চেষ্টা করেছিল কুশ-তার্দ, কিন্তু নিরাপত্তা ও খাদ্য সরবরাহ ইস্যুতে ফরাসি সরকার বাধা দেয়।
ব্যবসায়িক শক্তিমত্তা ও তুলনা
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ কুশ-তার্দের ১৭,০০০ স্টোর রয়েছে, যার ৬২% নিজেরা পরিচালনা করে। ৭-ইলেভেনের অধিকাংশ দোকান ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক। আয় একই রকম হলেও কুশ-তার্দের নিট মুনাফা ছিল ২.৭ বিলিয়ন ডলার, যেখানে সেভেন অ্যান্ড আই-এর ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার।
জঁদ্রঁ বলেন, “কুশ-তার্দ কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং জাপানের ব্যবসাটাই আসল রত্ন মনে করে।” জাপানে ফ্রেশ ফুড সরবরাহ ব্যবস্থা, শক্তিশালী সাপ্লাই চেইন এসবই আকর্ষণের বড় কারণ।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বিদ্যুৎচালিত গাড়ির প্রসারের ফলে পেট্রোল বিক্রি কমে যাবে—এই প্রেক্ষাপটে ফ্রেশ ফুড বিক্রির ওপর জোর দিচ্ছে কুশ-তার্দ। জঁদ্রঁ বলেন, “জাপানের কর্মীদের কীভাবে কাজ করতে হয়, তা বলে দেওয়ার লোক পাঠাবে না কুশ-তার্দ। বরং তারা গিয়ে বলবে, কীভাবে আমরা সহায়তা করতে পারি?”
তবে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কিছু খরচ সংকোচন, বিশেষ করে হেড অফিসে, হতে পারে। কুশ-তার্দের মন্ত্র হলো: “মুনাফা হয় মাঠে, অফিসে নয়।”
আলাঁ বুশারদের নেতৃত্বে কুশ-তার্দের এই সংগ্রাম শুধু ব্যবসায়িক নয়, এটি এক উদ্যোক্তার জীবনের নিষ্ঠা, ধৈর্য আর প্রতিশোধ স্পৃহার অনন্য দলিল। ৭-ইলেভেন অধিগ্রহণ সফল হলে তা হবে এক নতুন যুগের সূচনা—বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনভিনিয়েন্স চেইনের জন্ম।