০৯:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুলাই ২০২৫

একটি ডিম, অনেক অভাবের গল্প

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
  • 112

সারাক্ষণ রিপোর্ট

ডিমের বাজার এখন চড়া

বাংলাদেশে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ডিমের দাম আবারও হু হু করে বেড়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের দাম দাঁড়াচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকার মতো। অথচ কিছুদিন আগেও এই ডিম পাওয়া যেত ৯০–১০০ টাকায় ডজন। খামার পর্যায়ে উৎপাদন কমে যাওয়া, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি জেলায় ডিমের সরবরাহ কমে যাওয়াই এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

রিকশাচালক হাসেমের সংসারে ডিম বিলাসিতা

ঢাকার মালিবাগে বসবাস করেন রিকশাচালক হাসেম আলী। তিন সন্তানের বাবা হাসেম প্রতিদিন গড়ে ৫০০–৬০০ টাকা আয় করেন, তবে এই আয়ের মধ্যে রুম ভাড়া, চাল-ডাল, স্কুলের খরচ সামলানোতেই হিমশিম খেতে হয়। একবেলা ভালো করে মাছ বা মাংস রান্না করাও যেন অনেকটা উৎসবের মতো।

হাসেম জানালেন, “আগে সপ্তাহে ২–৩ দিন ডিম খেতে পারতাম, এখন মাসে একবারও খেতে পারি না। একটা ডিম ১২ টাকা, তিনটা ছেলে-মেয়ে মিলে দিনে ছয়টা লাগবে। তাতে তো শুধু ডিমেই ৭০ টাকার মতো চলে যায়, এটা কেমনে সম্ভব?”

তার স্ত্রী রোকসানা বলেন, “মেয়েটার শরীর দুর্বল, স্কুলে পড়ে। মাঝে মাঝে বলে—‘আম্মু, ডিম খাবো’। তখন খুব খারাপ লাগে, পারি না দিতে।”

দিনমজুর রহিমার হাড়ভাঙা পরিশ্রমকিন্তু পাতে ডিম নেই

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার পাশে ভাঙা ঘরে থাকেন রহিমা খাতুন, একজন দিনমজুর। দুই ছেলে ও এক নাতিকে নিয়ে তার ছোট সংসার। সকাল ছয়টায় কাজে বের হন, সারাদিন ইট টানা বা নির্মাণ কাজের মতো কঠোর শ্রম দেন। প্রতিদিনের আয় ৪৫০–৫০০ টাকা।

তিনি বললেন, “সকালবেলা একবেলা ভাত খাই, সন্ধ্যায় চিড়া-মুড়ি বা খিচুড়ি। ডিম কিনে খাই না অনেক মাস হলো। মাছ-মাংস তো স্বপ্ন। মাঝে মাঝে বাজারে যাই, দেখি কিন্তু কিনতে পারি না।”

পুষ্টির ঘাটতি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ডিম এমন একটি খাবার যা কম খরচে উচ্চ মানের প্রোটিন, ভিটামিন ডি, বি১২, আয়রন, কোলিন এবং ওমেগা-৩ সরবরাহ করে। কিন্তু দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিক বা কৃষিশ্রমিকদের পরিবারের জন্য এই ডিম এখন প্রায় বিলাসদ্রব্য।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে গড়ে ১৩৬টি ডিম খায়, অর্থাৎ সপ্তাহে প্রায় ২–৩টি। অথচ উন্নত দেশগুলোতে এই সংখ্যা ৩০০–৪০০। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সংখ্যা আরও অনেক কম।

কেন এই সংকট?

 

১. উৎপাদন সংকট: প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খামারে খাদ্য সংকটের কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
২. মূল্য নিয়ন্ত্রণহীনতা: বাজারে সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
৩. দরিদ্র মানুষের আয় অপর্যাপ্ত: নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লেও রিকশাচালক বা দিনমজুরদের আয় বাড়েনি।
৪. সচেতনতার অভাব: অনেক পরিবার জানে না ডিমের পুষ্টিগুণ বা স্বাস্থ্য উপকারিতা।

সমাধানের পথ

  • সরকারি ভর্তুকি ও সাবসিডি: দরিদ্র পরিবারের জন্য কম দামে ডিম সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • স্কুল মিল প্রোগ্রামে ডিম অন্তর্ভুক্ত: শিশুদের পুষ্টির জন্য স্কুলভিত্তিক খাদ্য কর্মসূচিতে ডিম রাখা যেতে পারে।
  • খামারিদের সহায়তা: ডিম উৎপাদকদের খাদ্য ও ঋণ সহায়তা দিলে উৎপাদন বাড়বে এবং দাম কমবে।
  • সচেতনতা কার্যক্রম: ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচার চালানো উচিত।

বাস্তবে ডিম কোনো বিলাসিতা নয়, এটি একটি মৌলিক খাদ্য। কিন্তু বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে রিকশাচালক ও দিনমজুরদের পাতে আজ ডিম নেই। এ সংকট শুধু খাদ্যের নয়, এটি একটি পুষ্টি ও মানবাধিকারের সংকট। এই সমস্যার সমাধানে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন, না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভোগ করবে অপুষ্টির মারাত্মক পরিণতি।

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৪২)

একটি ডিম, অনেক অভাবের গল্প

১২:০০:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

ডিমের বাজার এখন চড়া

বাংলাদেশে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ডিমের দাম আবারও হু হু করে বেড়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের দাম দাঁড়াচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকার মতো। অথচ কিছুদিন আগেও এই ডিম পাওয়া যেত ৯০–১০০ টাকায় ডজন। খামার পর্যায়ে উৎপাদন কমে যাওয়া, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি জেলায় ডিমের সরবরাহ কমে যাওয়াই এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।

রিকশাচালক হাসেমের সংসারে ডিম বিলাসিতা

ঢাকার মালিবাগে বসবাস করেন রিকশাচালক হাসেম আলী। তিন সন্তানের বাবা হাসেম প্রতিদিন গড়ে ৫০০–৬০০ টাকা আয় করেন, তবে এই আয়ের মধ্যে রুম ভাড়া, চাল-ডাল, স্কুলের খরচ সামলানোতেই হিমশিম খেতে হয়। একবেলা ভালো করে মাছ বা মাংস রান্না করাও যেন অনেকটা উৎসবের মতো।

হাসেম জানালেন, “আগে সপ্তাহে ২–৩ দিন ডিম খেতে পারতাম, এখন মাসে একবারও খেতে পারি না। একটা ডিম ১২ টাকা, তিনটা ছেলে-মেয়ে মিলে দিনে ছয়টা লাগবে। তাতে তো শুধু ডিমেই ৭০ টাকার মতো চলে যায়, এটা কেমনে সম্ভব?”

তার স্ত্রী রোকসানা বলেন, “মেয়েটার শরীর দুর্বল, স্কুলে পড়ে। মাঝে মাঝে বলে—‘আম্মু, ডিম খাবো’। তখন খুব খারাপ লাগে, পারি না দিতে।”

দিনমজুর রহিমার হাড়ভাঙা পরিশ্রমকিন্তু পাতে ডিম নেই

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার পাশে ভাঙা ঘরে থাকেন রহিমা খাতুন, একজন দিনমজুর। দুই ছেলে ও এক নাতিকে নিয়ে তার ছোট সংসার। সকাল ছয়টায় কাজে বের হন, সারাদিন ইট টানা বা নির্মাণ কাজের মতো কঠোর শ্রম দেন। প্রতিদিনের আয় ৪৫০–৫০০ টাকা।

তিনি বললেন, “সকালবেলা একবেলা ভাত খাই, সন্ধ্যায় চিড়া-মুড়ি বা খিচুড়ি। ডিম কিনে খাই না অনেক মাস হলো। মাছ-মাংস তো স্বপ্ন। মাঝে মাঝে বাজারে যাই, দেখি কিন্তু কিনতে পারি না।”

পুষ্টির ঘাটতি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ডিম এমন একটি খাবার যা কম খরচে উচ্চ মানের প্রোটিন, ভিটামিন ডি, বি১২, আয়রন, কোলিন এবং ওমেগা-৩ সরবরাহ করে। কিন্তু দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিক বা কৃষিশ্রমিকদের পরিবারের জন্য এই ডিম এখন প্রায় বিলাসদ্রব্য।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে গড়ে ১৩৬টি ডিম খায়, অর্থাৎ সপ্তাহে প্রায় ২–৩টি। অথচ উন্নত দেশগুলোতে এই সংখ্যা ৩০০–৪০০। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সংখ্যা আরও অনেক কম।

কেন এই সংকট?

 

১. উৎপাদন সংকট: প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খামারে খাদ্য সংকটের কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
২. মূল্য নিয়ন্ত্রণহীনতা: বাজারে সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়ছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
৩. দরিদ্র মানুষের আয় অপর্যাপ্ত: নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লেও রিকশাচালক বা দিনমজুরদের আয় বাড়েনি।
৪. সচেতনতার অভাব: অনেক পরিবার জানে না ডিমের পুষ্টিগুণ বা স্বাস্থ্য উপকারিতা।

সমাধানের পথ

  • সরকারি ভর্তুকি ও সাবসিডি: দরিদ্র পরিবারের জন্য কম দামে ডিম সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • স্কুল মিল প্রোগ্রামে ডিম অন্তর্ভুক্ত: শিশুদের পুষ্টির জন্য স্কুলভিত্তিক খাদ্য কর্মসূচিতে ডিম রাখা যেতে পারে।
  • খামারিদের সহায়তা: ডিম উৎপাদকদের খাদ্য ও ঋণ সহায়তা দিলে উৎপাদন বাড়বে এবং দাম কমবে।
  • সচেতনতা কার্যক্রম: ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচার চালানো উচিত।

বাস্তবে ডিম কোনো বিলাসিতা নয়, এটি একটি মৌলিক খাদ্য। কিন্তু বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে রিকশাচালক ও দিনমজুরদের পাতে আজ ডিম নেই। এ সংকট শুধু খাদ্যের নয়, এটি একটি পুষ্টি ও মানবাধিকারের সংকট। এই সমস্যার সমাধানে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন, না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভোগ করবে অপুষ্টির মারাত্মক পরিণতি।