সারাক্ষণ রিপোর্ট
দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ এক সময় বিদ্যুৎ-সংকটে ভুগলেও বিগত পনেরো বছরে বৈদ্যুতিক অবকাঠামোকে এমনভাবে শক্তিশালী করেছে যে, একসময়ের “আফ্রিকার বিদ্যুৎ-জায়ান্ট” খ্যাত নাইজেরিয়াকেও পেছনে ফেলেছে। বর্তমান বাংলাদেশে যেখানে প্রায় সবার ঘরে আলো জ্বলছে, নাইজেরিয়ায় ৯ কোটির বেশি মানুষ এখনও বিদ্যুৎ-বঞ্চিত।
নাইজেরিয়ার বিদ্যুৎ-সংকট
- জাতীয় গ্রিডে সর্বোচ্চ ৬ গিগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ কখনও প্রবাহিত হয়নি; অতিরিক্ত চাপেই প্রায়ই গ্রিড ধসে পড়ে।
- ২৩ কোটি জনসংখ্যার ৪৫ ভাগ—প্রায় ৯ কোটি মানুষ—কোনও দিন গ্রিড-সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ পাননি।
- জেনারেটর নির্ভরতা এতই বেশি যে, গ্রিড থেকে যেটুকু শক্তি আসে, জেনারেটর তার দ্বিগুণ সরবরাহ করে, ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ে ও দূষণ তীব্র হয়।
- বাংলাদেশের অগ্রগতি
- ক্যাপাসিটির লাফ: ২০০৯ সালে যেখানে মোট স্থাপিত ক্ষমতা ছিল সাড়ে ৫ গিগাওয়াট, ২০২৫ সালের এপ্রিল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ গিগাওয়াট—প্রায় ছয়গুণ বৃদ্ধি।
- প্রায় সার্বজনীন বিদ্যুৎ-সুবিধা: ২০২২ সালে বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতা ৯৯.৪ শতাংশে পৌঁছেছে; ৩০ বছরে ১০ কোটি মানুষের কাছে প্রথমবার বিদ্যুৎ পৌঁছেছে।
- বিতরণ ও রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন: পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (REB) এবং সোলার হোম সিস্টেমের (SHS) বিস্তার গ্রিড-বহির্ভূত এলাকায় দ্রুত আলো জ্বালিয়েছে।
নীতিগত চালিকা শক্তি
প্রণোদনা-ভিত্তিক IPP মডেল: স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদকদের (IPP) দীর্ঘমেয়াদি গ্যারান্টিযুক্ত ক্রয়-চুক্তি (PPA) বিনিয়োগ নিশ্চিত করে।
ঢালাও গ্রিড সম্প্রসারণ: ১ লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি নতুন ট্রান্সমিশন-লাইনের পাশাপাশি স্মার্ট সাব-স্টেশন স্থাপন।
জ্বালানি বৈচিত্র্য: গ্যাস-ভিত্তিক প্ল্যান্টের সঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG), কয়লা, নবায়নযোগ্য শক্তি ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (২০২৫-এ আংশিক চালু) যুক্ত করা।
সুবিধাভোগী-ভিত্তিক ভর্তুকি ও ট্যারিফ সংস্কার: নিম্ন-আয়ের গ্রাহককে সুরক্ষা দিয়ে বর্ধিত ব্যয় আদায় করা।
সার্বজনীন বিদ্যুৎ-সুবিধার পথে
বিশ্বব্যাংক-আইইএ বিশ্লেষণ বলছে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে বাংলাদেশে; অল্প সময়ে প্রায় পূর্ণ বিদ্যুৎ-কভারেজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দেশটি।
চ্যালেঞ্জ ও সামনে যা করতে হবে
- জ্বালানি আমদানি-নির্ভরতা: বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামে অস্থিরতা বজায় থাকলে ব্যয় বেড়ে যাবে।
- গ্রিড ভোল্টেজ-নিয়ন্ত্রণ ও আধুনিকীকরণ: উচ্চ চাহিদার সময়ে ভারসাম্য রক্ষায় আরও স্মার্ট সিস্টেম দরকার।
- নবায়নযোগ্য লক্ষ্য: ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি অর্জনে নীতি-সমন্বয় জরুরি।
বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে
বিদ্যুৎখাত বিশ্লেষক ড. মোমিনুল হক মনে করেন, “ব্যাক-আপ জেনারেটর নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশকে দ্রুত গ্রিডে সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য উৎস জুড়তে হবে। তবে সামগ্রিক উন্নয়নের নিরিখে গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎপথে ‘টাইগার টার্ন-অ্যারাউন্ড’ ঘটেছে, যা আফ্রিকার বৃহত্তম অর্থনীতিকেও অনুপ্রেরণা দিতে পারে।”
উপসংহার
এক দশক আগেও যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল নিত্যসঙ্গী, আজ বাংলাদেশ প্রায় ৩০ গিগাওয়াট স্থাপিত ক্ষমতাসহ সার্বজনীন বিদ্যুৎ-সুবিধার দ্বারপ্রান্তে। বিপরীতে, প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ নাইজেরিয়া এখনও টিকে আছে ৬ গিগাওয়াটের দুর্বল গ্রিড আর লক্ষ কোটি টাকার জেনারেটর নির্ভরতার উপর। উভয় দেশের অভিজ্ঞতা দেখায়, রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ ছাড়া বিদ্যুৎ-স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।