০৭:৩৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৫১) সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন: ভারতে দুই বছরের শিশুর কামড়ে গোখরা সাপের মর্মান্তিক মৃত্যু প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-২৫১) আমেরিকার পরমাণু গবেষণাগারে ভবিষ্যতের অস্ত্র ও শক্তির সন্ধান শাংহাইয়ে অ্যামাজনের এআই গবেষণা ল্যাব বন্ধ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আমাদের কম বুদ্ধিমান করে দিচ্ছে? ডাকাতিয়া নদী: শতবর্ষের যাত্রাপথে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার প্রাণ হিউএনচাঙ (পর্ব-১৫৯) ডানপন্থী উত্থান: শেখ হাসিনার শাসনের পর বাংলাদেশে চরম ডান শক্তির প্রসার নিয়ে বিএনপির শঙ্কা কামচাটকায় ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে সারা প্রশান্ত মহাসাগরে সুনামি সতর্কতা

ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির মাছ, আরও ৩০ প্রজাতি হুমকির মুখে

  • Sarakhon Report
  • ০৩:২৫:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
  • 165

সারাক্ষণ রিপোর্ট

মাছের রাজ্য এখন সংকটে

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চল, বিশেষ করে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, এক সময় ছিল মিঠা পানির মাছের এক বিশাল জৈবভাণ্ডার। শতাধিক দেশীয় মাছের প্রজাতি নদী, বিল ও হাওরে অবাধে বিচরণ করত। তবে এখনকার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন—নদীর গভীরতা কমেছে, পানি দূষিত হয়েছে, প্রজনন ব্যাহত হয়েছে এবং একের পর এক মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে।

এই অঞ্চলের মিঠা পানির মাছের বিলুপ্তি শুধু পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, স্থানীয় জীবিকা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপরও আঘাত হানে।

মাছের বৈচিত্র্য ধসে: হারিয়ে যাচ্ছে শত শত প্রজাতি

একসময় বাংলাদেশে ৩০০টিরও বেশি দেশীয় মিঠা পানির মাছের প্রজাতি ছিল। কিন্তু ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো জানাচ্ছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে অনেক প্রজাতির আর দেখা মেলে না। অন্তত ২০টির বেশি মাছ এখন বিপন্ন বা বিলুপ্তপ্রায়। নদীর স্রোতের গতি, তাপমাত্রার পরিবর্তন, অতিরিক্ত শিকার এবং দূষণের কারণে এগুলো ফলশ্রুতিতে তাদের আবাসস্থল হারিয়েছে।

বিলুপ্তপ্রায় ও হুমকির মুখে থাকা মাছের তালিকা

নিম্নে ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিলুপ্ত বা সংকটাপন্ন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাছের তালিকা তুলে ধরা হলো, যেগুলো কখনো নদী ও বিলের পরিচিত নাম ছিল:

মাছের নাম (বাংলা) বৈজ্ঞানিক নাম বর্তমান অবস্থা
আইড় Sperata aor দুষ্প্রাপ্য
পুঁটি Puntius sophore হ্রাসপ্রাপ্ত
রিঠা Rita rita দুষ্প্রাপ্য
বোয়াল Wallago attu সংকটাপন্ন
মেনি Notopterus notopterus দুর্লভ
বাঘাইর Bagarius bagarius সমালোচনামূলক বিপন্ন (CR)
তিলা শোল Channa barca সমালোচনামূলক বিপন্ন
ভাঙ্গনবাটা Labeo boga বিলুপ্তপ্রায়
নান্দিনা Labeo nandina বিলুপ্তপ্রায়
কৈরকা Schistura corica সংকটাপন্ন
কালা পাবদা Ompok pabo সংকটাপন্ন
চেনুয়া Sisor rabdophorus সমালোচনামূলক বিপন্ন
মহাশোল Tor tor বিলুপ্তপ্রায়

কেন হারিয়ে যাচ্ছে এই মাছগুলো?

অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা

জীবিকার তাগিদে জেলেরা সারা বছর, এমনকি প্রজনন মৌসুমেও মাছ ধরছেন। নিষিদ্ধ জাল ও ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি ব্যবহারে মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

জলদূষণ

কারখানার বর্জ্য, কৃষিজ কীটনাশক, পলিথিন ও গৃহস্থালি বর্জ্য নদীতে পড়ে পানি বিষাক্ত করছে। এতে ডিম ফুটতে পারে না, মাছের অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়

আবাসস্থল ধ্বংস

নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ড্রেজিং, বাঁধ নির্মাণ এবং জমি ভরাটের কারণে মাছের প্রাকৃতিক আবাস নষ্ট হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও মৌসুমী বৈচিত্র্য

অনিয়মিত বর্ষা, অধিক তাপমাত্রা ও খরার কারণে পানি স্তর কমে যাচ্ছে। এতে অনেক মাছ তাদের প্রজননের উপযোগী পরিবেশে পাচ্ছে না।

সংরক্ষণের উদ্যোগ: আশার আলো এখনও জ্বলছে

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) সহ বিভিন্ন সংস্থা বিলুপ্তপ্রায় মাছ রক্ষায় নিচ্ছে নানা পদক্ষেপ:

কৃত্রিম প্রজনন ও পুনঃপ্রবর্তন

BFRI গবেষণাগারে বিলুপ্তপ্রায় ৬৭টি প্রজাতির মধ্যে ৩৭টি প্রজাতিকে পুনরুজ্জীবন করা হয়েছে। এসব পোনা নদীতে অবমুক্ত করে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।

৩৩ জনকে চাকরি দেবে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

মাছের অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা

প্রজননের মৌসুমে নির্দিষ্ট কিছু নদী এলাকা ‘মাছের নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষণা করে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।

সম্প্রদায়ভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা

স্থানীয় জেলেদের নিয়ে গঠন করা হচ্ছে ‘মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটি’, যারা টেকসই শিকারের নিয়ম মেনে চলে এবং নদী রক্ষা করে।

আইনি পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা

মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার রোধ এবং স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার কাজ চলছে।

উপসংহার: এখনই জেগে ওঠার সময়

ময়মনসিংহ অঞ্চলের মিঠা পানির মাছের বৈচিত্র্য এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যা হারিয়ে গেলে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। শুধু মাছের সংখ্যা নয়, হারিয়ে যাচ্ছে একটি জীববৈচিত্র্য, একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং একটি প্রজন্মের খাদ্যনিরাপত্তা।

নদীকে বাঁচাতে হলে আগে বাঁচাতে হবে তার জীবন্ত প্রাণ—মাছকে। সরকার, গবেষক, স্থানীয় জনগণ এবং আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই সম্ভব এই সংকট মোকাবিলা করে আবারও ময়মনসিংহকে মাছের রাজ্যে পরিণত করা।

পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি- ৫১)

ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় মিঠা পানির মাছ, আরও ৩০ প্রজাতি হুমকির মুখে

০৩:২৫:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

মাছের রাজ্য এখন সংকটে

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চল, বিশেষ করে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, এক সময় ছিল মিঠা পানির মাছের এক বিশাল জৈবভাণ্ডার। শতাধিক দেশীয় মাছের প্রজাতি নদী, বিল ও হাওরে অবাধে বিচরণ করত। তবে এখনকার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন—নদীর গভীরতা কমেছে, পানি দূষিত হয়েছে, প্রজনন ব্যাহত হয়েছে এবং একের পর এক মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে।

এই অঞ্চলের মিঠা পানির মাছের বিলুপ্তি শুধু পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা, স্থানীয় জীবিকা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপরও আঘাত হানে।

মাছের বৈচিত্র্য ধসে: হারিয়ে যাচ্ছে শত শত প্রজাতি

একসময় বাংলাদেশে ৩০০টিরও বেশি দেশীয় মিঠা পানির মাছের প্রজাতি ছিল। কিন্তু ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো জানাচ্ছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে অনেক প্রজাতির আর দেখা মেলে না। অন্তত ২০টির বেশি মাছ এখন বিপন্ন বা বিলুপ্তপ্রায়। নদীর স্রোতের গতি, তাপমাত্রার পরিবর্তন, অতিরিক্ত শিকার এবং দূষণের কারণে এগুলো ফলশ্রুতিতে তাদের আবাসস্থল হারিয়েছে।

বিলুপ্তপ্রায় ও হুমকির মুখে থাকা মাছের তালিকা

নিম্নে ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিলুপ্ত বা সংকটাপন্ন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাছের তালিকা তুলে ধরা হলো, যেগুলো কখনো নদী ও বিলের পরিচিত নাম ছিল:

মাছের নাম (বাংলা) বৈজ্ঞানিক নাম বর্তমান অবস্থা
আইড় Sperata aor দুষ্প্রাপ্য
পুঁটি Puntius sophore হ্রাসপ্রাপ্ত
রিঠা Rita rita দুষ্প্রাপ্য
বোয়াল Wallago attu সংকটাপন্ন
মেনি Notopterus notopterus দুর্লভ
বাঘাইর Bagarius bagarius সমালোচনামূলক বিপন্ন (CR)
তিলা শোল Channa barca সমালোচনামূলক বিপন্ন
ভাঙ্গনবাটা Labeo boga বিলুপ্তপ্রায়
নান্দিনা Labeo nandina বিলুপ্তপ্রায়
কৈরকা Schistura corica সংকটাপন্ন
কালা পাবদা Ompok pabo সংকটাপন্ন
চেনুয়া Sisor rabdophorus সমালোচনামূলক বিপন্ন
মহাশোল Tor tor বিলুপ্তপ্রায়

কেন হারিয়ে যাচ্ছে এই মাছগুলো?

অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা

জীবিকার তাগিদে জেলেরা সারা বছর, এমনকি প্রজনন মৌসুমেও মাছ ধরছেন। নিষিদ্ধ জাল ও ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি ব্যবহারে মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

জলদূষণ

কারখানার বর্জ্য, কৃষিজ কীটনাশক, পলিথিন ও গৃহস্থালি বর্জ্য নদীতে পড়ে পানি বিষাক্ত করছে। এতে ডিম ফুটতে পারে না, মাছের অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়

আবাসস্থল ধ্বংস

নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ড্রেজিং, বাঁধ নির্মাণ এবং জমি ভরাটের কারণে মাছের প্রাকৃতিক আবাস নষ্ট হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও মৌসুমী বৈচিত্র্য

অনিয়মিত বর্ষা, অধিক তাপমাত্রা ও খরার কারণে পানি স্তর কমে যাচ্ছে। এতে অনেক মাছ তাদের প্রজননের উপযোগী পরিবেশে পাচ্ছে না।

সংরক্ষণের উদ্যোগ: আশার আলো এখনও জ্বলছে

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) সহ বিভিন্ন সংস্থা বিলুপ্তপ্রায় মাছ রক্ষায় নিচ্ছে নানা পদক্ষেপ:

কৃত্রিম প্রজনন ও পুনঃপ্রবর্তন

BFRI গবেষণাগারে বিলুপ্তপ্রায় ৬৭টি প্রজাতির মধ্যে ৩৭টি প্রজাতিকে পুনরুজ্জীবন করা হয়েছে। এসব পোনা নদীতে অবমুক্ত করে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।

৩৩ জনকে চাকরি দেবে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

মাছের অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা

প্রজননের মৌসুমে নির্দিষ্ট কিছু নদী এলাকা ‘মাছের নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষণা করে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।

সম্প্রদায়ভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা

স্থানীয় জেলেদের নিয়ে গঠন করা হচ্ছে ‘মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটি’, যারা টেকসই শিকারের নিয়ম মেনে চলে এবং নদী রক্ষা করে।

আইনি পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতা

মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার রোধ এবং স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার কাজ চলছে।

উপসংহার: এখনই জেগে ওঠার সময়

ময়মনসিংহ অঞ্চলের মিঠা পানির মাছের বৈচিত্র্য এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যা হারিয়ে গেলে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। শুধু মাছের সংখ্যা নয়, হারিয়ে যাচ্ছে একটি জীববৈচিত্র্য, একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং একটি প্রজন্মের খাদ্যনিরাপত্তা।

নদীকে বাঁচাতে হলে আগে বাঁচাতে হবে তার জীবন্ত প্রাণ—মাছকে। সরকার, গবেষক, স্থানীয় জনগণ এবং আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই সম্ভব এই সংকট মোকাবিলা করে আবারও ময়মনসিংহকে মাছের রাজ্যে পরিণত করা।