সারাক্ষণ রিপোর্ট
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ডলারের ভাসমান বিনিময় হার চালু এবং বিদ্যুৎ খাতে ৪৬% ভর্তুকি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট গার্মেন্টস, খুচরা ব্যবসা এবং ছোট পরিসরের আমদানিকারকেরা এই দুই সিদ্ধান্তের সম্মিলিত অভিঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে উৎপাদন ও খুচরা বিক্রি—সব ক্ষেত্রেই বেড়েছে খরচ, সংকুচিত হয়েছে মুনাফা এবং ধসে পড়ছে টিকে থাকার সক্ষমতা।
ডলারের ভাসমান রেটঃ ছোট ব্যবসায় অস্থিরতা
২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক “স্মার্ট ফ্লোট” পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক নির্ধারণে ছেড়ে দেয়। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১ মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য যেখানে ১০৫–১১০ টাকার মধ্যে থাকতো, ২০২৫ সালের মে মাসে তা দাঁড়িয়েছে ১১৭–১২৩ টাকায় (সূত্রঃ বাংলাদেশ ব্যাংক)। খোলাবাজারে এক রেট, ব্যাংকে আরেক রেট—এতে আমদানিকারকদের পূর্ব পরিকল্পনা ও বাজেট ভেস্তে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের মোবাইল এক্সেসরিজ আমদানিকারক বলেনঃ
“আমরা সাধারণত তিন মাস আগে অর্ডার দিই। ডলার রেট যদি ৫–৬ টাকা ওঠানামা করে, তাহলে পুরো পণ্যের মুনাফা শেষ হয়ে যায়। এখন ৩০% বাড়তি মূলধন নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে।”
বিদ্যুৎ ভর্তুকি প্রত্যাহারঃ উৎপাদন ব্যয়ের ওপর চাপ
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সরকার ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ভর্তুকি কমিয়ে দেয়, যার ফলে ইউনিটপ্রতি গড় দাম ৭.২৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১.৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে (সূত্রঃ বিইআরসি)। ভাসমান রেটের কারণে প্রতি ত্রৈমাসিকে নতুন রেট কার্যকর হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধির পরিসংখ্যান (গার্মেন্টস কারখানা):
সময় | ইউনিটপ্রতি দাম (টাকা) | গড় মাসিক বিল |
ডিসেম্বর ২০২৩ | ৭.২৫ | ১.৮ লাখ |
মার্চ ২০২৫ | ১১.৬০ | ২.৬ লাখ |
সাভারের সাব-কন্ট্রাক্ট গার্মেন্ট মালিক সুমন হোসেন বলেনঃ
“যেখানে প্রতি পিস পোশাকের উৎপাদন খরচ ছিল ৯০ টাকা, এখন সেটা ১০৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ বায়ার বাড়তি দাম দিচ্ছে না।”
ক্ষুদ্র ব্যবসা: দুমুখো সংকটে আয় কমেছে ২৫–৪০%
- ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বেড়েছে
- বিদ্যুৎ ব্যয়ে দোকান পরিচালনার খরচ বেড়েছে
- দ্রব্যমূল্য বাড়ায় ভোক্তা চাহিদা কমেছে
পুরান ঢাকার প্যাকেজিং সামগ্রীর ব্যবসায়ী বলেনঃ
“আগে যেটা ৫ হাজার টাকায় আমদানি করতাম, এখন সেটাই ৬৫০০ টাকায় পড়ে। কিন্তু বিক্রি বাড়াতে পারিনি, ফলে লাভ ৪০% কমে গিয়েছে।”
ছোট আমদানিকারকদের জন্য এলসি খোলা এখন মরুভূমির পিপাসা
ব্যাংকগুলো এখন ছোট আমদানিকারকদের এলসি খুলতে নিরুৎসাহিত করছে। কারণ:
- ডলার সংকট
- পর্যাপ্ত জামানত না থাকা
- রেট ওঠানামার ঝুঁকি
চট্টগ্রামের কসমেটিকস আমদানিকারক বলেনঃ
“বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাংক লাইন অফ ক্রেডিট দেয়, কিন্তু আমরা ১০ হাজার ডলার এলসি খুলতেও ভোগান্তিতে পড়ি।”
সংগঠনের বক্তব্যঃ সরকারকে সতর্ক থাকার আহ্বান
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন (মার্চ ২০২৫):
“বিদ্যুৎ ভর্তুকি প্রত্যাহারে ক্ষুদ্র গার্মেন্টসরা টিকতে পারবে না। তাদের জন্য বিশেষ সাপোর্ট প্যাকেজ জরুরি।”
FBCCI-এর প্রেসবিজ্ঞপ্তি:
“ডলার ফ্লোটের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে ক্ষুদ্র আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের। সরকারকে সীমিত হারে প্রণোদনা দিতে হবে।”
ঢাকা চেম্বার (DCCI):
“বাজারমুখী বিনিময় হার গ্রহণযোগ্য, কিন্তু এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য ট্রানজিশনকালীন সহায়তা না থাকলে তারা বিপন্ন হবে।”
সম্ভাব্য পরিণতি ও সামাজিক প্রভাব
- ছোট কারখানায় কর্মসংস্থান কমেছে ২০–২৫%
- ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি পেয়েছে (এসএমই খাতে NPL বেড়েছে ১৫%)
- শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্তদের আয় হ্রাস পাচ্ছে
- মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি
বিশ্লেষকদের সুপারিশ
অর্থনীতি বিশ্লেষকঃ
“এই পরিবর্তনগুলো কাঠামোগত সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও, সরকারকে এখনই সাবসিডি, রিবেট কিংবা প্রণোদনার মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের রক্ষা করতে হবে। নইলে দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা কমে যাবে।”
প্রস্তাবনা: সরকার কী করতে পারে?
পদক্ষেপ | বিবরণ |
টার্গেটেড ভর্তুকি | ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ ভর্তুকি সীমিত পরিসরে চালু |
ডলার প্রণোদনা | ক্ষুদ্র আমদানিকারকদের জন্য নির্দিষ্ট হারে ডলার বরাদ্দ |
স্বল্পসুদে ঋণ | রিফাইন্যান্স স্কিম চালু করে ক্যাশ ফ্লো মেইনটেইন করা |
বিকল্প বিদ্যুৎ উৎস | সোলার প্যানেল স্থাপনে ভর্তুকি/প্রণোদনা |
বাজারভিত্তিক রেটে পূর্বাভাস | বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক পূর্বাভাস দিয়ে অনিশ্চয়তা কমানো |
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে দীর্ঘমেয়াদে সুফল আসবে, তবে তা যেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব সংকটে না ফেলে। ডলার ভাসমান ও বিদ্যুৎ ভর্তুকি প্রত্যাহারের মতো পদক্ষেপ বাস্তবায়নে লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তা না থাকলে তা সার্বিক শিল্প কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলবে। এখনই সময়, যেখানে সরকার, ব্যাংক এবং ব্যবসায় সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন ক্ষুদ্র অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে।