সারাক্ষণ রিপোর্ট
ভোরের ঘ্রাণেই দুঃশ্চিন্তা
শেষ রাতের শিশির সবে শুকিয়েছে। কুলতিয়া বাজারের পাশ দিয়ে যখন রিকশাভ্যানগুলো কর্কশ শব্দ তুলে এগিয়ে যায়, তখন বাতাসে ভাসে পাকা হিমসাগরের ঘ্রাণ। কিন্তু সেই সুগন্ধের ভেতরেই মিশে আছে হতাশার আঁচ। বাঁকড়া গ্রামের চাষি মিজানুর রহমান গামছা দিয়ে ঝরাপড়া আম মুছতে‑মুছতেই বললেন—
“৪০ কেজির ‘মণ’ এখন ৪৮ কেজি মেপে নেয় ব্যাপারীরা। ৪৫ টাকা দামে বেচলে ৮ কেজি ফ্রি দিয়ে আসতে হচ্ছে—হিসাবটা করেন, লাভ থাকল কই?”
.দামের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে লাভ
এ বছর জেলার বড়বাজারগুলোতে হিমসাগর বিক্রি হয়েছে ১,৮০০–২,২০০ টাকা/মণ—মানে ৪৫‑৫৫ টাকা/কেজি। অথচ উৎপাদন খরচই কেজিপ্রতি ৩৮‑৫০ টাকা। বকচর ইউনিয়নের রিনা খাতুন স্বামীসহ ২ বিঘা বাগান লিজ নিয়েছেন:
“সার, কিটনাশক, শ্রম—সবই বেড়েছে। ৫০ টাকায় বিক্রি করে ভাড়া দিলেই তহবিল শেষ।”
‘আগে পাড়ো, পরে দেখো’—সময়ের ফাঁদ
জেলার প্রশাসন এবার পাড়া‑শুরু পাঁচ দিন এগিয়ে এনেছিল। উদ্দেশ্য—ঝড়ের ক্ষতি এড়ানো। ফল? একই দিনে শত শত ট্রাক আমে ছেয়ে যায় বাজার। তফসিলায়ের সুজন গাইন ক্ষুব্ধ—
“যখন সবাই একসঙ্গে আম নামায়, তখন তো দাম পড়বেই। আমরা বলি — প্রথম ঝড়টা পেরোতে দিক, তারপর পাড়লে আমও মিষ্টি হবে, দামও থাকবে।”
ঠাঁই‑না‑ফুটো বাজার আর ঠান্ডাঘরের হাহাকার
জেলাজুড়ে বড়সড় কেবল সুলতানপুর হাট। চারদিকে ইঁদুর‑কলোর ভিড়, গরমে দ্রুত পচা শুরু। কুশখালি এলাকার প্রান্তিক চাষি আলতাফ মল্লিক বুক চাপড়ে বলেন—
“দুই দিন হিমসাগর পড়ে থাকলে আগা থেকে কালচে হয়। হিমাগার থাকলে অন্তত পাঁচ দিন ধরে রাখতাম, ১০‑১৫ টাকা বেশি পেতাম।”
সুদের ফাঁসে শাঁখ‑বাঁশি
অনেকে মৌসুম শুরুতেই মহাজনের কাছে আগাম টাকা নেন। প্রতি মণ বিক্রিতে তাঁদের দিতে হয় ‘শেয়ার’। তালতলা গ্রামের মো. আসলাম শেখ হিসাব কষে দেখান—
“লোনের সুদ, মহাজনের ভাগ আর ওজন কারচুপি মিলিয়ে প্রায় এক‑তৃতীয়াংশ আম উধাও। মৌসুম শেষে ঋণ শোধের টাকাই থাকে না।”
কৃষি কর্মকর্তারা কী বলেন?
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান (অফিসার) জানালেন—
“ক্লাস্টারভিত্তিক হিমাগার ও ডিজিটাল ওজন‑ব্যবস্থা চালুর প্রকল্প আছে; তবে সেটি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ। আপাতত বাজার ভিন্নীকরণে মোবাইল‑হাট ও অনলাইন বিক্রি বাড়াতে আমরা সহায়তা দিচ্ছি।”
আশা কি একদম নেই?
- ডাইরেক্ট টু কনজিউমার (D2C) মডেলে ঢাকায় কুরিয়ারে আম পাঠিয়ে কেজিপ্রতি ৬৫‑৭০ টাকা পাওয়ার উদাহরণ দেখিয়েছেন কয়েকজন তরুণ উদ্যোক্তা।
- জিএপি সনদ পেলে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত ওঠার সম্ভাবনা।
- ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল ওজনস্কেল ক্যাম্প ও বাগান‑স্তরের ক্রয়কেন্দ্র চালুর দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
শেষ কথা
হিমসাগরের মধুর রস জিভে লাগলেও চাষিদের মুখে এখন তিতকুটে স্বাদ। ওজন‑কারচুপি, সরবরাহ‑জট, আগাম‑লোন আর সংরক্ষণ‑সঙ্কট—এই চার মিলে সাতক্ষীরার কৃষকের মুনাফা মাটি করে দিচ্ছে। ৬০‑৭০ টাকা/কেজি দামের নিচে তারা মূলধনই তুলতে পারছেন না।
তবু মধুমেয় আম‑বাগানেই তাঁরা ভরসা রাখেন। দাম না বাড়ুক, অন্তত সুবিচার হোক—এটাই তাঁদের ‘মিষ্টি’ প্রার্থনা।