প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের ক্ষমতা ত্যাগের পর বাংলাদেশ এক ভয়াবহ “মব ভায়োলেন্সে” নিমজ্জিত হয়, যা দেশের সামাজব্যবস্থা ও আইনের শাসনকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়—কোনো গোষ্ঠীই রেহাই পায়নি। বর্তমানের এই পরিস্থিতিতে ২১ মে ২০০২৫, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান জাতিকে নৈরাজ্য থামাতে একজোট হওয়ার আহ্বান জানান।
মব ভায়োলেন্সের ক্রমবর্ধমান মাশুল
২০২৪‑এর আগস্টের পর থেকে দেশে গণপিটুনি ও মব ভায়োলেন্স মারাত্মক বেড়েছে। মানবাধিকার সহায়তা সমাজ (এইচআরএসএসের) তথ্য মতে, মাত্র সাত মাসে ১১৪ টি গণহেনস্তার ঘটনায় অন্তত ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২৪ সালে ১২৮ জনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে—সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আক্রান্ত: ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের ওপর হামলার ২২৫ টি ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। এই ব্যাপক আইনহীনতা ‘নিজ হাতে বিচার’ সংস্কৃতিকেই আরও উসকে দিচ্ছে।
উগ্রপন্থী ছাত্রনেতা ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর সুপরিকল্পিত তাণ্ডব
চোখের দেখা ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন ইঙ্গিত দেয়, এই হিংসার অনেক ঘটনাই স্বতঃস্ফূর্ত নয়—পূর্বপরিকল্পিত। কিছু উগ্রপন্থী ছাত্রনেতা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর, নারীদের ওপর হামলা এবং সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে সহিংসতা চালায়। মৌলবাদী দলগুলো এই অস্থির সময়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের চিন্তাধারা চাপিয়ে দিতে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন বাড়িয়েছে।
বিশেষত নারী ও কিশোরীরা ভোগান্তির শিকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, নারীকে ঘর থেকে টেনে বের করে বা গণপরিবহন থেকে নামিয়ে নির্দয়ভাবে মারধর করা হচ্ছে—আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
জাতীয় ঐতিহ্য ও উপাসনালয়ের বিনাশ
দেশের “ফাউন্ডিং ফাদার” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবনে হামলা দেশের মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস‑এর একটি ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উত্তেজিত জনতা বাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে স্বাধীনতার স্মৃতিবস্তু লুট করে।এবং সেখানে একটি বিশেষ পতাকা উড়তে দেখা যায়।
একই রকম দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহমদিয়া মসজিদে। সেখানে উগ্রবাদীরা নামাজের স্থান ভাঙচুর, ধর্মীয় গ্রন্থ অপবিত্র করে এবং উপাসকদের হুমকি দিয়ে যায়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস‑এর ওই প্রতিবেদনে এসব ঘটনাকে কেবল অপরাধ নয়, সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সেনাপ্রধানের আলটিমেটাম
সহিংসতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় ২১ মে ২০২৫‑এ এক যৌথ নিরাপত্তা ব্রিফিংয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান দৃঢ় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন—
“‘মব ভায়োলেন্স’‑এর নামে সৃষ্ট সহিংসতা আর বরদাশত করা হবে না। যারা আইন ভাঙবে, তারা আইনের শক্তিই মোকাবিলা করবে।”
তার বক্তব্যটি টেলিভিশন ও অনলাইনে ব্যাপক সমর্থন পায়। একই সঙ্গে তিনি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচন নিশ্চিতে শৃঙ্খলা ফেরানোর ওপর জোর দেন।
করণীয় পথ
বাংলাদেশকে আরও গভীর খাদের দিকে পড়া ঠেকাতে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়েরই দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন:
• পরিকল্পনাকারী ও উসকানিদাতাদের—ছাত্রনেতা হোক বা ধর্মীয় বক্তা—আইনের আওতায় আনা
• পুলিশকে স্বাধীনভাবে ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা
• সংখ্যালঘু, নারী ও শিশুদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় জরুরি সুরক্ষা প্রোটোকল চালু করা
• ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা—বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও আহমদিয়া উপাসনালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা—পুনর্নির্মাণ ও সুরক্ষিত করা
জাগরণের ঘণ্টা
মব ভায়োলেন্স, জাতীয় স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস, নিরীহ জনগণের ওপর আক্রমণ—এসব শুধু অপরাধ নয়; এগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল্যবোধের প্রত্যাখ্যান। উগ্র ছাত্ররাজনীতির একটি অংশ ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর সক্রিয় সম্পৃক্ততা সরাসরি মোকাবিলা না করলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারই হবে।
জেনারেল ওয়াকার উজ জামান যে সতর্কবার্তা দিয়েছেন, তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন জরুরি—শুধু আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং ইতিহাসকে আগুনে পুড়তে না দেওয়ার জন্য।
ঐক্যবদ্ধ থাকলেই কেবল বাংলাদেশ ন্যায়বিচার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির অঙ্গীকার পুনরুদ্ধার করতে পারবে।