অষ্টম পরিচ্ছেদ
উঠে পড়ে সতর্কভাবে হাটতে শুরু করলুম। একটা মাঠ পেরিয়ে দেখলুম খানিকটা দূরে একখানা গ্রাম। গ্রামের ছোট-ছোট কুড়েগুলো যেন পাহাড়ের পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়ে আছে। খড়ের চালওয়ালা শাদা শাদা মাটির কু’ড়েগুলোকে দূর থেকে দেখতে লাগছিল যেন একগোছা বাদামী টোপরওয়ালা ব্যাঙের ছাতা। কিন্তু গাঁয়ে ঢুকতে সাহস হল না। মাঠ পেরিয়ে আমরা একটা ছোটখাট বনের মধ্যে ঢুকলুম।
হঠাৎ থেমে পড়ে, গাছের ফাঁক দিয়ে ঝিলিক-দেয়া লালরঙের টিনের চালের একটা কোণের দিকে আঙুল দেখিয়ে আমি ফিসফিস করে বললুম, ‘একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।’
অতর্কিতে পাছে আক্রান্ত হই এই ভয়ে সাবধানে গুঁড়ি মেরে আমরা বাড়িটার উ’চু বেড়ার ধার পর্যন্ত এগোলুম। গেটটা ছিল তালাবন্ধ। বাড়িটা থেকে না-শোনা যাচ্ছিল কুকুরের ডাক বা মুরগির কোঁকর-কোঁ, না গোয়ালে গোরুর খুরের শব্দ।
সবকিছু ছিল একদম চুপচাপ। যেন মনে হচ্ছিল আমরা আসছি বলে যত ক’টা জনপ্রাণী ছিল বাড়িটায় সব লুকিয়ে পড়েছে। বাড়িটার চারপাশ একবার ঘুরে দেখলুম আমরা, কিন্তু ভেতরে ঢোকার কোনো রাস্তা খুঁজে পেলুম না।
চুবুক বললেন, ‘আমার পিঠের উপরি উঠে বেড়ার উপর দিয়ে ভেতরটা একবার দ্যাখো দিকি।’
বেড়ার ওপর দিয়ে চারিদিক তাকিয়ে দেখলুম। খালি চোখে পড়ল খামারবাড়ির শূন্য উঠোনে ঘাস গজিয়ে গেছে আর ফুলের কেয়ারিগুলো পায়ে দলাই মলাই করা। কেবল এখানে-ওখানে পায়ে-পেষা দু-চারটে ডালিয়া ফুল আর নীল তারা-চোখো প্যানজি তখনও ধুকপুক করে বেঁচে আছে।
‘হল?’ চুবুক অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নেবে পড় দিকি। কী ভাবো আমার শরীলটারে পাথরে-গড়া না কি!’
লাফিয়ে নেমে পড়ে বললুম, ‘কেউ কোথাও নেই। বাড়িটার সামনের জানলাগুলো সব তক্তা সে’টে বন্ধ করা আর পাশের জানলাগুলোর চৌকাঠ পর্যন্ত লোপাট হয়ে গেছে। দেখেই মনে হয়, লোক থাকে না এখানে, পোড়ো বাড়ি একটা। তবে উঠোনে একটা পাতকুয়ো আছে।’