সারাংশ
১. ডেঙ্গু ভাইরাসের সব চারটি সিরোটাইপই এখন সক্রিয়, বড় আকারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
২. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে সর্বোচ্চ স্তরের (গ্রেড-৩) জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
৩. এবার ডেঙ্গু সিজন আগাম আসতে পারে, আর বর্ষা দীর্ঘায়িত হলে ডেঙ্গু মৌসুমও লম্বা হবে।
৪. সরকার–গৃহীত কোনো কার্যকর প্রস্তুতি এখনো জনসাধারণের চোখে পড়ছে না।
বর্তমান রোগীর চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের সর্বশেষ বুলেটিন বলছে, ২৫ মে ২৪-ঘণ্টায় ১১৫ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছর শুরুর পর থেকে মোট ভর্তি ৩,৯৭২ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২৩-এ দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারি-এপ্রিল মাসভিত্তিক ভর্তি ছিল যথাক্রমে ১,১৬১; ৩৭৪; ৩৩৬ ও ৭০১ জন। মে মাসের প্রথম ২৪ দিনেই ভর্তি হয়েছে ১,৪০০ জন।
কেন উদ্বেগ বাড়ছে
২০২৩ সালে দেশ রেকর্ড ৩,২১,১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি ও ১,৭০৫টি মৃত্যু দেখেছে—এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞদের মতে, চারটি সিরোটাইপই সক্রিয় থাকায় পুনরায় বড় ঢেউয়ের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত
সিঙ্গাপুর জানুয়ারি-মে ২০২৫ সময়ে মাত্র ১,৯০০ ডেঙ্গু রোগী ও ২ টি মৃত্যু নথিভুক্ত করে আগের বছরের তুলনায় ৭৪ শতাংশ কমাতে পেরেছে; ওয়োলবাকিয়া প্রযুক্তিসহ আগাম প্রস্তুতি এখানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। অথচ বিশ্বজুড়ে ২০২৪ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণ ১ কোটি ৪৩ লাখ ৫৭ হাজার ছাড়িয়ে ১০,৫৭৬ মৃত্যুতে পৌঁছেছে—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে সর্বোচ্চ স্তরের (গ্রেড-৩) জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
জলবায়ু ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী সপ্তাহেই ঢাকাসহ উপকূলীয় বিভাগগুলোয় মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। টানা বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে, বিশেষ করে জুন-সেপ্টেম্বরের ‘পিক সিজন’কে আরও দীর্ঘ করতে পারে।
বাজেট কাটছাঁট ও সরকারি উদাসীনতা
বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মাঝেই আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট—যেখানে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব রয়েছে। সমগ্র স্বাস্থ্যখাত থেকে কাটছাঁট হচ্ছে ২৫,০০০ কোটি টাকা; বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ মোট ব্যয়ের মাত্র ৫ শতাংশেরও কম, অথচ স্বাস্থ্য-সংস্কার কমিশন অন্তত ১৫ শতাংশ চেয়েছিল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ‘রোগ-প্রতিরোধে বিনিয়োগ না বাড়িয়ে শুধু নতুন বিছানা খুলে মরদেহ গোনার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।’ সর্বোপরি, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত আইসিইউ-বেড, গ্লাভস ও স্যালাইনের সংকট রয়ে গেছে। অনেকে অভিযোগ করছেন, গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিকিৎসক রাজনৈতিক কারণে নিয়মিত উপস্থিত নন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশন
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় কোনো জোরালো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং সর্বত্র অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও অনিশ্চিত রাজনীতির প্রভাব অনুভূত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞের সতর্কবার্তা
- ডা. মেহেদী হাসান,ভাইরাস বিশেষজ্ঞ: ‘২০২৪ সালের রেকর্ডের পর জনগণের শরীরে আংশিক ইমিউনিটি তৈরি হলেও সিরোটাইপ বদল হলে বড় ঢেউ ফিরতে পারে।’
• প্রফেসর সেলিম রায়হান, অর্থনীতিবিদ: ‘স্বাস্থ্য-খাতে কাটছাঁট মানে ভবিষ্যতে চিকিৎসা-খরচ জনগণের ঘাড়ে চাপানো। রোগ বাড়বে, দারিদ্র্যও বাড়বে।’
কী করতে হবে এখনই
- মশা নিয়ন্ত্রণে জরুরি বরাদ্দ বাড়াতে হবে; ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কীটনাশক কর্মসূচি সারা বছর চালু রাখতে তহবিল নিশ্চিত করতে হবে।
- বাসাবাড়ি-ভিত্তিক নজরদারি: প্রতিটি ওয়ার্ডে ‘গো-ওয়ান্টেড’ টিম গঠন করে সপ্তাহে দু’দিন পাত্রভর্তি পানি পরীক্ষা ও ধ্বংস করতে হবে।
- ডিজিটাল কেস-ট্র্যাকিং: DGHS-এর ডেঙ্গু ড্যাশবোর্ড উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে রিয়েল-টাইম তথ্য উন্মুক্ত করতে হবে।
- বাজারে সহজলভ্য রক্ত ও স্যালাইন: পিপিপি-মডেলে অন্তত ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে আইভি স্যালাইন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
- গণসচেতনতা প্রচার: টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ৩০-সেকেন্ডের ‘বালতি উল্টাও, জীবন বাঁচাও’ ভিডিও-ক্যাম্পেইন অব্যাহত রাখতে হবে।
এক দিকে মৌসুমি বৃষ্টি, অন্য দিকে দ্রুত নগরায়ণ—বাংলাদেশ ডেঙ্গুর জন্য কার্যত ‘পারফেক্ট স্টর্ম’। অথচ ঝড় মোকাবিলার আগেই বাজেট-ছাঁট কাঁচি চালিয়ে সরকার বোঝাচ্ছে, জনস্বাস্থ্য তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় এখনও পেছনে। সময় আছে—বাজেট পাসের আগে সদিচ্ছা দেখানোই পারে ডেঙ্গুর ডানা ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ।