তিনি আরো বলেন, ‘‘আরো যে দল আছে যেমন জামায়াত, তারা রোজার আগে নির্বাচন চায়৷ সেটা ফেব্রুয়ারি মাসে৷ তিনি (ড. ইউনূস) আর তার দল এনসিপি শুধু ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চান না৷ আর সবাই চায়৷”
‘‘তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, আইন-শৃঙ্খলা কোনো পরিস্থিতিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না৷ একটি নির্বাচনই পারে দেশকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে৷ কিন্তু উনি যা করছেন তাতে দেশে আরো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে৷ তার ক্ষমতা ধরে রাখার এই ইচ্ছা দেশে সংকট তৈরি করবে৷”, বলেন রুমিন ফারহানা৷
ইউনূসের সমালোচনায় রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো
প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্যের সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট৷ এতে বলা হয়েছে, ‘‘একটি দল বাদে কেউ ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না–এমন বক্তব্য সত্যের অপলাপমাত্র৷ এই বক্তব্য দুরভিসন্ধিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷”
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, শুধু একটি দল নয়, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ দেশের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ৫০টির বেশি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়৷
তাই দ্রুত প্রয়োজনীয় নির্বাচনি সংস্কার করে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানানো হয়েছে বিবৃতিতে৷
বাম গণতান্ত্রিক জোট বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘এজেন্ডা বাস্তবায়ন’ এবং ‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়’ নবগঠিত দলকে রাজনৈতিক সুবিধা দেয়ার জন্য নির্বাচন পেছানোর অপকৌশল নিয়েছে৷”
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘একই উদ্দেশে ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়’ নবগঠিত একটি রাজনৈতিক দল এবং ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক দল ও গোষ্ঠী নির্বাচন বানচাল করতে দেশে অস্থিতিশীল-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির নানা রকম অপতৎপরতা চালাচ্ছে৷ যা দেশকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত করবে৷”
ওই জোটের শরিক সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে ওই কথা বলছেন৷ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইলেও তিনি তা মানছেন না৷ তিনি একটা বিভাজন তৈরি করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘এর আগে তারা যতগুলো দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবার পদত্যাগ নিয়ে কথা ওঠার পর কম সংখ্যক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ বাম গণতান্ত্রিক জোটকেও ডাকেনি৷ উদ্দেশ্য হলো, যারা তাদের মতের সঙ্গে একমত হবে তাদের সংখ্যা বৈঠকে বেশি দেখানো৷ আসলে প্রফেসর ইউনূস এখন একটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে চাচ্ছেন নির্বাচন না দেয়ার৷ যেটা তার পক্ষে যায়৷ আর এজন্য হয়তো আরো দল গজাবে, তৈরি করা হবে তার পক্ষে বলার জন্য৷”
এই বামপন্থি নেতা বলেন, ‘‘আমাদের বিবেচনায় ৫৫টির মতো দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়৷ আর অন্য কিছু দল আছে তারা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারির কথা বলছে৷ সেটাও তো কাছাকাছি সময়৷ মূল বিষয় হলো, বাংলাদেশে নির্বাচন করার ভালো সময় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি৷ বর্ষাকালে বাংলাদেশে নির্বাচন হয় না৷”
এই ইস্যুতে ১২ দলীয় জোটও এক বিবৃতি দিয়েছে৷ তারা বলেছে, ‘‘কেবল একটি দল নয়, দেশের সব দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়৷”
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘কেবল একটি দলই নয়, দেশের সব গণতন্ত্রপন্থি দল স্পষ্টভাবে নয় মাস ধরে ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে এসেছে৷ বরং তিনি (ড. ইউনূস)
নিজে কিছু মৌলবাদী, জনসমর্থনহীন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনের প্রশ্নটিকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছেন, করছেন৷”
গণফোরাম তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা সঠিক বলেননি৷”
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে গণফোরাম৷”
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং এর ফলে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে৷”
সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন চায় এনসিপি
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, ‘‘বড় দল হিসাবে বিএনপি বার বার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের চাপ দিচ্ছে৷ তাই হয়তো প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, একটিমাত্র দলই ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী বছরের ৩০ জুনের পর তিনি একদিনও থাকবেন না৷ তিনি তো বলেছেন ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন হবে৷ কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে৷ সেটার রোডম্যাপ না হলে সরকারকে তারা সহযোগিতা করবে না৷ বিএনপিই শুধু এভাবে বলছে৷ আর কোনো বড় দল এভাবে বলছে না৷ ফলে, প্রধান উপদেষ্টা আমরা মনে হয় এই কারণেই শুধু বিএনপির কথা বলেছেন৷ তবে কেন বলেছেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন৷”
মনিরা শারমিন বলেন, ‘‘সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন-এই তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করছে সরকার৷ ফলে আমরা মনে করি ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব৷ দেশের মানুষতো সংস্কার চায়, বিচার চায়৷”
কোনো দল একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের দাবি করতে পারে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘‘কিন্তু তাদের কথা মতো তো নির্বাচন হবে না৷ সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করবেন৷ বিএনপি যেভাবে চাপ দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, তাদের কথা মতোই নির্বাচন হতে হবে৷”
‘লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকতে চান ইউনূস’
শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য তিনটি শক্তি মূখ্য৷ সরকার, সেনাবাহিনী ও বিএনপি৷ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত হওয়ার পর বাংলাদেশে বিএনপিকে একটি দল হিসাব করে প্রধান উপদেষ্টা যে কথা বলছেন তা তো হাস্যকর৷ মানুষের সমর্থন, ভোটার এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে৷ বিএনপির পরে আছে জামায়াতে ইসলামী৷ ভোটের বিবেচনায় তাদের অবস্থান অনেক নীচে৷ আর এনসিপির তো কোনো অবস্থানই তৈরি হয়নি৷ তাদের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের একটি অংশের ছাত্ররা আছে মাত্র৷”
তিনি বলেন, ‘‘আসলে প্রফেসর ইউনূস একটি মাত্র দলের কথা বলে একটি বয়ান তৈরি করতে চান৷ কোনো সংস্কার ও বিচার কাজ দৃশ্যমান না হলেও এটার কথা বলে তিনি সময় পার করতে চান৷ নানা মাধ্যমে তার সরকারের পাঁচ বছর থাকার প্রয়োজনীতা নানাভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷ আমার মনে হয়, তিনি নানা অজুহাতে একটা লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকতে চান৷ এর সেই কারণেই একেক সময় একেক কথা বলে নতুন নতুন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছেন৷”
নির্বাচন ইস্যুতে সরকার ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে বলে মনে করেন এই রাজনীতি বিশ্লেষক৷ তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি ডিসেম্বরেই নির্বাচনে অনড়৷ আর সেনবাহিনীও ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়৷ ফলে সামনে কী পরিস্থিতি হয়, তা দেখার আছে৷”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমদে মনে করেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা একটা ঝামেলা পাকাতে চাইছেন৷ তিনি এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করতে চাচ্ছেন৷ তিনি যেভাবে কথা বলছেন, তা একজন রাষ্ট্রনায়কের মুখে মানায় না৷ তিনি তো দলীয় সরকারের প্রধান না৷ তিনি তো একটি নির্দলীয় সরকারের প্রধান৷”
একটি মাত্র দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়-ড. ইউনূস এমন মন্তব্য করে বিএনপিকে নিজের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করাতে চাইছেন বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ৷
তিনি বলেন, ‘‘ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষ বিপক্ষ তৈরি করতে চাইছেন৷ তার কাজ তো হলো সবার সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের ব্যবস্থা করা৷ আমরা তো কোনো কাজই হচ্ছে বলে দেখছি না৷”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার বিবেচনায় তিনি (ড. ইউনূস) দেশে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চান৷ বিএনপি যদি মাঠে নামে আর এনসিপিও যদি নামে তাহলে তো সংঘাত হবে৷ তিনি তখন দেশের ওই খারাপ অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণের চেষ্টা করবেন৷ তবে, এটা সফল তবে কী না আমি জানি না৷”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রেফারি ভূমিকায় থাকার কথা ছিল প্রধান উপদেষ্টার৷ কিন্তু তিনি এখন একটি পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন৷ তিনি এবং এনসিপি এক হয়ে কাজ করছেন বলেও অভিযোগ করছেন তারা৷ সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দেয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়ছে বলেও মনে করছেন তারা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের প্রধান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, থামতে না জানা৷ কোথায় থামতে হবে তা তারা বুঝতে পারেন না৷ প্রধান উপদেষ্টার মধ্যেও ওই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷ এখন যেটা হচ্ছে, তা হলো প্রধান উপদেষ্টা রেফারির ভূমিকার বাইরে চলে যাচ্ছেন৷ কোনো একটা পক্ষ নিচ্ছেন৷ এটা সংকট তৈরি করবে৷”
ক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছে, তিনি কোনো একটি দলকে সময় দিতে চান৷ এই কারণেই নির্বাচন নিয়ে স্বচ্ছ কথা বলছেন না৷ তিনি আরো সময় নিতে চান৷ আর সংস্কার ও বিচারের ব্যাপারেও আমরা স্পষ্ট করে কিছু পাচ্ছি না৷ আসলে তিনি যদি দুই বছর পরও নির্বাচন করতে চান তাহলে কবে কীভাবে করতে চান, তা পরিষ্কারভাবে বলা উচিত৷ সেটা না করায় তার প্রতি অবিশ্বাস ও সন্দেহ বাড়ছে৷ আর এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে গণতন্ত্রায়নের পথে তা বড় বাধা তৈরি করবে৷”
বৈঠকের ডাক পেলো বিএনপি
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, আলোচনার জন্য আগামী ২ জুন বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ শনিবার (৩১ মে) দুপুরে রাজধানীতে কৃষক দলের এক আলোচনায় সভায় তিনি এ কথা বলেছেন৷
ফ্যাসিবাদের কূটচালে জাতির মধ্যে একটি গোষ্ঠী বিভেদ সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ করেন এই বিএনপি নেতা৷ তিনি বলেন, ‘‘সংস্কারের নামে কলা ঝুলানো হচ্ছে৷ ডিসেম্বরের আগেই নির্বাচন দিতে হবে, এটা জনগণের দাবি৷ ডিসেম্বরের পর নির্বাচন দেওয়ার কোনো কারণ নেই৷”
প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷ এ প্রসঙ্গে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷