০৪:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫
  • 49

নজরুল

সেদিন কবির আগমনে বালুচরের কৃষাণ-পল্লীতে সাড়া পড়িয়া গেল। ওপাড়া হইতে আজগর ফকিরকে খবর দেওয় হইল, চর-কেষ্টপুরের মথুর ফকিরও আসিলেন। তাঁহারা যখন গান ধরিলেন, তখন মনে হইল আল্লার আসমান গানের সুরে কাঁপিতেছে। কবি সে গানের খুব তারিফ করিলেন। কিন্তু তবু মনে হইল, যেমনটি করিয়া কবিকে এই গানে মাতাইতে চাহিয়াছিলাম, তাহা হইল না। সেই সময়ে কবির মন রণদুন্দুভির নিনাদে ভরপুর ছিল। এইসব গ্রাম্য-গানের ভাববস্তুর জন্য কবির হৃদয়ে কোনো স্থান তৈরি হয় নাই।

রাত্রিবেলা এক মুশকিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠিলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া যে চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিকালে কে সাহস করিয়া এত বড় পদ্মানদী পাড়ি দিবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠানো হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েকটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া তাজ্জব বানাইয়া দিবার জন্য কলিকাতা হইতে তিনি কিছু চা-পাতা লইয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা-পাতা যখন কম হইয়া আসিত, তখন তাহার সহিত কিছু শুকনা ঘাসপাতা মিশাইয়া চায়ের ভাণ্ডার তিনি অফুরন্ত রাখিতেন। তিনি অতি গর্বের সহিত তাঁহার কলিকাতা-ভ্রমণের আশ্চর্য কাহিনী বলিতে বলিতে সেই চা-পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ!

এই মহামূল্য চা এখন কে জ্বাল দিবে? এ বাড়ির বড়বউ, ও বাড়ির ছোটবউ-সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যাহার যত রন্ধনবিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া সেই অপূর্ব চা-রন্ধন-পর্ব সমাধা করিল। অবশেষে চা বদনায় ভরতি হইয়া বৈঠকখানায় আগমন করিল। কবির সঙ্গে আমরাও তাহার কিঞ্চিৎ প্রসাদ পাইলাম। কবি তো মহাপুরুষ। চা পান করিতে করিতে চা-রাঁধুনিদের অজস্র প্রশংসা করিতেছিলেন। আমরাও কবির সঙ্গে ধুয়া ধরিলাম। গ্রাম্য-চাষীর বাড়িতে যত রকমের তরকারি রান্না হইয়া থাকে, সেই চায়ের মধ্যে তাহার সবগুলিরই প্রসাদ মিশ্রিত ছিল। কমিউনিস্টকর্মী আবদুল হালিম বড় সমালোচনাপ্রবণ। তাঁহার সমালোচনা মতে সেই চা-রামায়ণের রচয়িত্রীরা নাকি লঙ্কাকাণ্ডের উপর বেশি জোর দিয়াছিলেন। আমার মতে চা-পর্বে সকল ভোজনরসের সবগুলিকেই সম মর্যাদা দেওয়া হইয়াছিল। পরবর্তীকালে বহু গুণীজনের কাছে এই চা খাওয়ার বর্ণনা করিয়া করি আনন্দ পরিবেশন করিতেন।

পরদিন পূর্ব আকাশে অপূর্ব দ্যুতি-মনোহর জবাকুসুমের রঙে রঙিন হইয়া সূর্যোদয় হইল। আমরা কবিকে লইয়া বিদায় হইলাম। দুই পাশের শস্যক্ষেত্রে সবুজ নতুন পত্র-মঞ্জুরি দেখা দিগয়াছে। রাতের শিশির-স্নাত পত্রগুলি বিহানবেলার রৌদ্রে ঝলমল করিয়া কবিকে অর্ভ্যথনা করিতেছিল।

‘কবি ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙ্গার গান’ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। এই বই দুইখানি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। কবির শিষ্যদল কনফারেন্সের অধিবেশনে এই বই বিক্রয় করিবার জন্য আনিয়াছিলেন। বইগুলি আমার বাড়িতে রাখিয়া কবি ফরিদপুর শহরে কনফারেন্সের ময়দানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। থাকিবার জন্য তাঁহাকে একটি তাঁবু দেওয়া হইল। আমি হইলাম কবির খাস-ভলান্টিয়ার।

এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের বহু নেতা আসিয়াছিলেন। তখন কবি ভালো বক্তৃতা করিতে শেখেন নাই। সভায় কবি যাহা বলিলেন, তাহা নিতান্ত মামুলি ধরনের। কিন্তু কবি যখন গান ধরিলেন, সেই গানের কথায় সমস্ত সভা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। কবি গান ছাড়িলে সভার লোকে আরও গান শুনিবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। কবির কণ্ঠস্বর যে খুব সুন্দর ছিল তাহা নয়, কিন্তু গান গাহিবার সময় গানের কথাবস্তুকে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিলেন। কবি যখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’ অথবা ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সভায় যে অপূর্ব ভাবরসের উদয় হইতেছিল, তাহা ভাষায় বলিবার নয়। জেল হইতে সদ্য খালাস পাইয়া বহু দেশকর্মী সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। দেশকে ভালোবাসিয়া শতসহস্র কর্মী আপন অঙ্গে লাঞ্ছনার তিলক-চিহ্ন ধারণ করিয়াছিলেন। নজরুলের, গান যেন তাঁহাদের দুঃখ-লাঞ্ছনার আশা-আকাঙ্ক্ষার জীবন্ত প্রতীক।

চলবে…..

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯৫)

১১:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫

নজরুল

সেদিন কবির আগমনে বালুচরের কৃষাণ-পল্লীতে সাড়া পড়িয়া গেল। ওপাড়া হইতে আজগর ফকিরকে খবর দেওয় হইল, চর-কেষ্টপুরের মথুর ফকিরও আসিলেন। তাঁহারা যখন গান ধরিলেন, তখন মনে হইল আল্লার আসমান গানের সুরে কাঁপিতেছে। কবি সে গানের খুব তারিফ করিলেন। কিন্তু তবু মনে হইল, যেমনটি করিয়া কবিকে এই গানে মাতাইতে চাহিয়াছিলাম, তাহা হইল না। সেই সময়ে কবির মন রণদুন্দুভির নিনাদে ভরপুর ছিল। এইসব গ্রাম্য-গানের ভাববস্তুর জন্য কবির হৃদয়ে কোনো স্থান তৈরি হয় নাই।

রাত্রিবেলা এক মুশকিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠিলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া যে চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিকালে কে সাহস করিয়া এত বড় পদ্মানদী পাড়ি দিবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠানো হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েকটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া তাজ্জব বানাইয়া দিবার জন্য কলিকাতা হইতে তিনি কিছু চা-পাতা লইয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা-পাতা যখন কম হইয়া আসিত, তখন তাহার সহিত কিছু শুকনা ঘাসপাতা মিশাইয়া চায়ের ভাণ্ডার তিনি অফুরন্ত রাখিতেন। তিনি অতি গর্বের সহিত তাঁহার কলিকাতা-ভ্রমণের আশ্চর্য কাহিনী বলিতে বলিতে সেই চা-পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ!

এই মহামূল্য চা এখন কে জ্বাল দিবে? এ বাড়ির বড়বউ, ও বাড়ির ছোটবউ-সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যাহার যত রন্ধনবিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া সেই অপূর্ব চা-রন্ধন-পর্ব সমাধা করিল। অবশেষে চা বদনায় ভরতি হইয়া বৈঠকখানায় আগমন করিল। কবির সঙ্গে আমরাও তাহার কিঞ্চিৎ প্রসাদ পাইলাম। কবি তো মহাপুরুষ। চা পান করিতে করিতে চা-রাঁধুনিদের অজস্র প্রশংসা করিতেছিলেন। আমরাও কবির সঙ্গে ধুয়া ধরিলাম। গ্রাম্য-চাষীর বাড়িতে যত রকমের তরকারি রান্না হইয়া থাকে, সেই চায়ের মধ্যে তাহার সবগুলিরই প্রসাদ মিশ্রিত ছিল। কমিউনিস্টকর্মী আবদুল হালিম বড় সমালোচনাপ্রবণ। তাঁহার সমালোচনা মতে সেই চা-রামায়ণের রচয়িত্রীরা নাকি লঙ্কাকাণ্ডের উপর বেশি জোর দিয়াছিলেন। আমার মতে চা-পর্বে সকল ভোজনরসের সবগুলিকেই সম মর্যাদা দেওয়া হইয়াছিল। পরবর্তীকালে বহু গুণীজনের কাছে এই চা খাওয়ার বর্ণনা করিয়া করি আনন্দ পরিবেশন করিতেন।

পরদিন পূর্ব আকাশে অপূর্ব দ্যুতি-মনোহর জবাকুসুমের রঙে রঙিন হইয়া সূর্যোদয় হইল। আমরা কবিকে লইয়া বিদায় হইলাম। দুই পাশের শস্যক্ষেত্রে সবুজ নতুন পত্র-মঞ্জুরি দেখা দিগয়াছে। রাতের শিশির-স্নাত পত্রগুলি বিহানবেলার রৌদ্রে ঝলমল করিয়া কবিকে অর্ভ্যথনা করিতেছিল।

‘কবি ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙ্গার গান’ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। এই বই দুইখানি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। কবির শিষ্যদল কনফারেন্সের অধিবেশনে এই বই বিক্রয় করিবার জন্য আনিয়াছিলেন। বইগুলি আমার বাড়িতে রাখিয়া কবি ফরিদপুর শহরে কনফারেন্সের ময়দানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। থাকিবার জন্য তাঁহাকে একটি তাঁবু দেওয়া হইল। আমি হইলাম কবির খাস-ভলান্টিয়ার।

এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের বহু নেতা আসিয়াছিলেন। তখন কবি ভালো বক্তৃতা করিতে শেখেন নাই। সভায় কবি যাহা বলিলেন, তাহা নিতান্ত মামুলি ধরনের। কিন্তু কবি যখন গান ধরিলেন, সেই গানের কথায় সমস্ত সভা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। কবি গান ছাড়িলে সভার লোকে আরও গান শুনিবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। কবির কণ্ঠস্বর যে খুব সুন্দর ছিল তাহা নয়, কিন্তু গান গাহিবার সময় গানের কথাবস্তুকে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিলেন। কবি যখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া’ অথবা ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সভায় যে অপূর্ব ভাবরসের উদয় হইতেছিল, তাহা ভাষায় বলিবার নয়। জেল হইতে সদ্য খালাস পাইয়া বহু দেশকর্মী সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। দেশকে ভালোবাসিয়া শতসহস্র কর্মী আপন অঙ্গে লাঞ্ছনার তিলক-চিহ্ন ধারণ করিয়াছিলেন। নজরুলের, গান যেন তাঁহাদের দুঃখ-লাঞ্ছনার আশা-আকাঙ্ক্ষার জীবন্ত প্রতীক।

চলবে…..