নজরুল
তাঁহার ভিতরে কবি এবং দেশপ্রেমিক এক সঙ্গে বাসা বাঁধিয়াছিল। আদর্শবাদী-নেতা এবং সাহিত্যিকের সমন্বয় সাধিত হইয়াছিল। চল্লিশ দিন অনশনের পর কবি অন্ন গ্রহণ করিলেন। তারপর জেল হইতে বাহির হইয়া আসিলে চারিদিকে কবির জয়-ডঙ্কা বাজিতে লাগিল। আমার মতো শিশু-কবির ক্ষীণ কণ্ঠস্বর সেই মহা কলরব ভেদ করিয়া কবির কানে পৌঁছিতে পারিল না।
আমি তখন সবে আই এ ক্লাসে উঠিয়াছি। আমার কবিতার রচনারীতি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। পূর্বে রবীন্দ্র-রচনার পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া যাহা লিখিতাম, বহু কাগজে তাহা ছাপা হইয়াছে। এমন কি ‘প্রবাসী’ কাগজে পর্যন্ত আমার লেখা প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু গ্রাম্য-জীবন লইয়া গ্রাম্য-ভাষায় যখন কবিতা রচনা করিতে আরম্ভ করিলাম, কেহই তাহা পছন্দ করিল না। কাগজের সম্পাদকেরা আমার লেখা পাওয়া মাত্র ফেরত পাঠাইয়া দিতেন। সবটুকু হয়তো পড়িয়াও দেখিতেন না। সে সময়ে আমার মনে যে কি দারুণ দুঃখ হইত, তাহা বর্ণনার অতীত।
একবার গ্রীষ্মকালে দুপুরবেলা আমাদের গ্রামের মাঠ দিয়া চলিয়াছি, এমন সময় পিয়ন আসিয়া ‘ভারতবর্ষ’ হইতে অমনোনীত ‘বাপের বাড়ির কথা’ নামক কবিতাটি ফেরত দিয়া গেল। পিয়ন চলিয়া গেলে আমি মনোদুঃখে সেই ঢেলা-ভরা চষা-ক্ষেতের মধ্যে লুটাইয়া পড়িলাম। কিন্তু চারিদিক হইতে যতই অবহেলা আসুক না কেন আমার মনের মধ্যে জোর ছিল। আমার মনে ভরসা ছিল, আমি যাদের কথা লিখিতেছি, আরও ভালো করিয়া লিখিতে পারিলে নিশ্চয় দেশ একদিন আমার কবিতার আদর করিবে।
সেই সময়ে আমার কেবলই মনে হইত, একবার যদি কবি নজরুলের সঙ্গে দেখা করিতে পারি, নিশ্চয় তিনি আমার কবিতা পছন্দ করিবেন। গ্রাম-জীবন লইয়া কবিতা লিখিতে আমি গ্রাম্য-কবিদের রচিত গানগুলিরও অনুসন্ধান করিতেছিলাম। আমার সংগৃহীত কিছু গ্রাম্য-গান দেখিয়া পরলোকগত সাহিত্যিক যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় আমাকে শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে দেখা করিতে পরামর্শ দেন।
কংগ্রেস-অফিসের সাময়িক স্বেচ্ছাসেবক হইয়া তাহাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করিতে করিতে আমি কলিকাতা আসিয়া উপস্থিত হই। পথের যত ধূলি আর গুঁড়া-কয়লা রজক-গৃহ-সম্পর্কহীন আমার শ্রীঅঙ্গের মোটা খদ্দরে, কিস্তি-নৌকার মতো চর্ম-পাদুকা জোড়ায় এবং তৈলহীন চুলের উপর এমন ভাবে আশ্রয় লইয়াছিল যে, তাহার আবরণীর তল ভেদ করিয়া আমার পূর্বপরিচিত কেহ আমাকে সহজে আবিষ্কার করিতে পারিত না। সুবিস্তৃত জন-অরণ্য কলিকাতায় আমি কাহাকেও চিনি না। কোথায় গিয়া আশ্রয় পাইব? কে আমাকে থাকিবার জায়গা দিবে? যদি কবি নজরুলের সন্ধান পাই, তাঁর স্নেহের শিশু-কবিকে নিশ্চয়ই তিন অবহেলা করিবেন না। মুসলিম পাবলিশিং হাউসে আসিয়া আফজল মিঞার কাছে কবির সন্ধান লইলাম।
আফজল মিঞা বলিলেন, “আপনি অপেক্ষা করুন। কবি একটু পরেই এখানে আসবেন।”
অল্পক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের বেগে কবি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
আফজল সাহেব বলিলেন, “জসীমউদ্দীন এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে।”
“কই জসীমউদ্দীন?” বলিয়া কবি এদিক-ওদিক চাহিলেন।
আফজল সাহেব আমাকে দেখাইয়া দিলেন। আমি কবিকে সালাম করিলাম।
কবি আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “কই, তোমার লেখা কোথাও তো দেখিনে?” আমি কবির নিকট আমার কবিতার খাতাখানা আগাইয়া দিতে গেলাম। কিন্তু কবি তাঁহার গুণ-গ্রাহীদের দ্বারা এমনই পরিবৃত হইলেন যে, আমি তার ব্যুহভেদ করিয়া কবির নিকটে পৌঁছিতে পারিলাম না।
চলবে…..