০৮:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিল আবুল খায়ের গ্রুপ “ওরা করলে, আমরা প্রস্তুত”: পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা ইস্যুতে রাজনাথ সিংয়ের হুঁশিয়ারি বেঙ্গালুরুর জেলে আইএস জঙ্গি ও সিরিয়াল ধর্ষকের মোবাইল ব্যবহার ফাঁস, তদন্তে নেমেছে কর্ণাটক সরকার পাকিস্তানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের অভূতপূর্ব পদোন্নতি — এখন দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ বর্তমানের সব জাতীয় সংকটই সরকারের সাজানো নাটক: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা ও ট্যারিফ বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশিতে আদানি পাওয়ার” ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে আধুনিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর নতুন বেতন কমিশন গঠন করবে পরবর্তী সরকার: সালেহউদ্দিন আহমেদ নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পাঁচ মামলায় জামিন প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিতে সহানুভূতির আহ্বান জানালেন জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পারওয়ার

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯২)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
  • 113

নজরুল

কবি কিন্তু তাঁর জীবনে ইহাদের ভোলেন নাই। মাসিমাকে কবি একখানা সুন্দর শাড়ি উপহার দিয়াছিলেন। মৃত্যুর আগে মাসিমা বলিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহাকে শ্মশানে লইয়া যাইবার সময় যেন তাঁর মৃতদেহ সেই শাড়িখানা দিয়া আবৃত করা হয়। মাসিমার বড় বোন বিরজাসুন্দরী দেবী অশ্রুসজল নয়নে আমাকে বলিয়াছিলেন, “তোমার মাসিমার সেই শেষ ইচ্ছা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিল।”

বহুদিন কবির চিঠি পাই না। হঠাৎ এক পত্র পাইলাম, কবি ‘ধূমকেতু’ নাম দিয়া একখানা সাপ্তাহিক পত্র বাহির করিতেছেন। তিনি আমাকে লিখিয়াছেন, ‘ধূমকেতু’র গ্রাহক সংগ্রহ করিতে। ছেলেমানুষ আমি-আমার কথায় কে ‘ধূমকেতু’র গ্রাহক হইবে? সুফি মোতাহার হোসেন অধুনা কবিখ্যাতিসম্পন্ন। সে তখন জেলা ইস্কুলের বোর্ডিং-এ থাকিয়া পড়াশুনা করিত। সে আমার কথায় ‘ধূমকেতু’র গ্রাহক হইল। তখন দেশে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলন চলিতেছিল। দেশের নেতারা পুঁথিপত্র ঘাঁটিয়া এই রক্তপাতহীন আন্দোলনের নজির খুঁজিতেছিলেন।

নজরুলের ‘ধূমকেতু’ কিন্তু রক্তময় বিপ্লববাদের অগ্নিস্বাক্ষর লইয়া বাহির হইল। প্রত্যেক সংখ্যায় নজরুল যে অগ্নিউদগারি সম্পাদকীয় লিখিতেন, তাহা পড়িয়া আমাদের ধমনীতে রক্তপ্রবাহ ছুটিত। সেই সময়ে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে যে মারণ-যজ্ঞের আয়োজন করিয়াছিলেন, নজরুল-সাহিত্য তাহাতে অনেকখানি ইন্ধন যোগাইয়াছিল। তাঁহার সেই সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলি আমরা বার বার পড়িয়া মুখস্থ করিয়া ফেলিলাম। একটি প্রবন্ধের নাম ছিল ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’। ভারতমাতা অন্তরিক্ষ হইতে বলিতেছেন, “আমি রক্ত চাই, নিজ সন্তানের রক্ত দিয়া তিমিররাত্রির বুকে নব-প্রভাতের পদরেখা অঙ্কিত করিব।” ‘ধুমকেতু’র মধ্যে যে সব খবর বাহির হইত, তাহার মধ্যেও কবির এই সুরটির রেশ পাওয়া যাইত।

‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত একটি কবিতার জন্য কবিকে গ্রেপ্তার করা হইল। বিচারে কবির জেল হইল। জেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা না মানার জন্য কর্তৃপক্ষ কবির প্রতি কঠোর হইয়া উঠিলেন। কবি অনশন আরম্ভ করিলেন। কবির অনশন যখন তিরিশ দিনে পরিণত হইল, তখন সারা দেশ কবির জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিল। রবীন্দ্রনাথ হইতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পর্যন্ত সকলেই কবিকে অনাহারব্রত ভঙ্গ করিতে অনুরোধ করিলেন। কবি নিজ সঙ্কল্পে অচল অটল। তখনকার দিনে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্তপ্রতীক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সভাপতিত্বে কবির অনশন উপলক্ষে গভর্নমেন্টের কার্যের প্রতিবাদে কলিকাতায় বিরাট সভার অধিবেশন হইল।

সেই সভায় হাজার হাজার লোক কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাইলেন। দেশবন্ধু তাঁহার উদাত্ত ভাষায় কবির মহাপ্রতিভার উচ্চপ্রশংসা করিলেন। বাংলাদেশের খবরের কাগজগুলিতে প্রতিদিন নজরুলের অনশনের অবস্থা লইয়া খবর বাহির হইতে লাগিল। নজরুলের কাব্য-মহিমা বাঙালির হৃদয়-তন্ত্রীতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। নজরুলের বিজয়-বৈজয়ন্তীর সে কী-ই না যুগ গিয়াছে। কেহ কেহ বলিতে লাগিলেন, নজরুল রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বড় কবি।

অনশনব্রত কবির জীবনে একটা মহাঘটনা। যাঁহারা কবিকে জানেন, তাঁহারা লক্ষ করিয়াছেন কবি সংযম কাহাকে বলে জানিতেন না। রাজনৈতিক বহু নেতা এরূপ বহুবার অনশন-ব্রত অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা ছিলেন ত্যাগে অভ্যস্ত। কবির মতো একজন প্রাণ-চঞ্চল লোক কি করিয়া জেলের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া একাদিক্রমে চল্লিশ দিন অনাহারে কাটাইয়াছিলেন তাহা একেবারে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়। কিন্তু নজরুল জীবনের এই সময়টি এক মহামহিমার যুগ। কোনো অন্যায়ের সঙ্গেই মিটমাট করিয়া চলিবার পাত্র তিনি ছিলেন না। সেই সময়ে দেখিয়াছি, কত অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া তাঁহার দিন গিয়াছে। যদি একটু নরম হইয়া চলিতেন, যদি লোকের চাহিদা মতো কিছু লিখিতেন, তবে সম্মানের আর সম্পদের সিংহাসন আসিয়া তাঁহার পদতলে লুটাইত।

 

চলবে…..

জনপ্রিয় সংবাদ

জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিল আবুল খায়ের গ্রুপ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯২)

১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫

নজরুল

কবি কিন্তু তাঁর জীবনে ইহাদের ভোলেন নাই। মাসিমাকে কবি একখানা সুন্দর শাড়ি উপহার দিয়াছিলেন। মৃত্যুর আগে মাসিমা বলিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহাকে শ্মশানে লইয়া যাইবার সময় যেন তাঁর মৃতদেহ সেই শাড়িখানা দিয়া আবৃত করা হয়। মাসিমার বড় বোন বিরজাসুন্দরী দেবী অশ্রুসজল নয়নে আমাকে বলিয়াছিলেন, “তোমার মাসিমার সেই শেষ ইচ্ছা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিল।”

বহুদিন কবির চিঠি পাই না। হঠাৎ এক পত্র পাইলাম, কবি ‘ধূমকেতু’ নাম দিয়া একখানা সাপ্তাহিক পত্র বাহির করিতেছেন। তিনি আমাকে লিখিয়াছেন, ‘ধূমকেতু’র গ্রাহক সংগ্রহ করিতে। ছেলেমানুষ আমি-আমার কথায় কে ‘ধূমকেতু’র গ্রাহক হইবে? সুফি মোতাহার হোসেন অধুনা কবিখ্যাতিসম্পন্ন। সে তখন জেলা ইস্কুলের বোর্ডিং-এ থাকিয়া পড়াশুনা করিত। সে আমার কথায় ‘ধূমকেতু’র গ্রাহক হইল। তখন দেশে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলন চলিতেছিল। দেশের নেতারা পুঁথিপত্র ঘাঁটিয়া এই রক্তপাতহীন আন্দোলনের নজির খুঁজিতেছিলেন।

নজরুলের ‘ধূমকেতু’ কিন্তু রক্তময় বিপ্লববাদের অগ্নিস্বাক্ষর লইয়া বাহির হইল। প্রত্যেক সংখ্যায় নজরুল যে অগ্নিউদগারি সম্পাদকীয় লিখিতেন, তাহা পড়িয়া আমাদের ধমনীতে রক্তপ্রবাহ ছুটিত। সেই সময়ে বিপ্লবীরা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে যে মারণ-যজ্ঞের আয়োজন করিয়াছিলেন, নজরুল-সাহিত্য তাহাতে অনেকখানি ইন্ধন যোগাইয়াছিল। তাঁহার সেই সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলি আমরা বার বার পড়িয়া মুখস্থ করিয়া ফেলিলাম। একটি প্রবন্ধের নাম ছিল ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’। ভারতমাতা অন্তরিক্ষ হইতে বলিতেছেন, “আমি রক্ত চাই, নিজ সন্তানের রক্ত দিয়া তিমিররাত্রির বুকে নব-প্রভাতের পদরেখা অঙ্কিত করিব।” ‘ধুমকেতু’র মধ্যে যে সব খবর বাহির হইত, তাহার মধ্যেও কবির এই সুরটির রেশ পাওয়া যাইত।

‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত একটি কবিতার জন্য কবিকে গ্রেপ্তার করা হইল। বিচারে কবির জেল হইল। জেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা না মানার জন্য কর্তৃপক্ষ কবির প্রতি কঠোর হইয়া উঠিলেন। কবি অনশন আরম্ভ করিলেন। কবির অনশন যখন তিরিশ দিনে পরিণত হইল, তখন সারা দেশ কবির জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিল। রবীন্দ্রনাথ হইতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পর্যন্ত সকলেই কবিকে অনাহারব্রত ভঙ্গ করিতে অনুরোধ করিলেন। কবি নিজ সঙ্কল্পে অচল অটল। তখনকার দিনে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্তপ্রতীক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সভাপতিত্বে কবির অনশন উপলক্ষে গভর্নমেন্টের কার্যের প্রতিবাদে কলিকাতায় বিরাট সভার অধিবেশন হইল।

সেই সভায় হাজার হাজার লোক কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাইলেন। দেশবন্ধু তাঁহার উদাত্ত ভাষায় কবির মহাপ্রতিভার উচ্চপ্রশংসা করিলেন। বাংলাদেশের খবরের কাগজগুলিতে প্রতিদিন নজরুলের অনশনের অবস্থা লইয়া খবর বাহির হইতে লাগিল। নজরুলের কাব্য-মহিমা বাঙালির হৃদয়-তন্ত্রীতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। নজরুলের বিজয়-বৈজয়ন্তীর সে কী-ই না যুগ গিয়াছে। কেহ কেহ বলিতে লাগিলেন, নজরুল রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বড় কবি।

অনশনব্রত কবির জীবনে একটা মহাঘটনা। যাঁহারা কবিকে জানেন, তাঁহারা লক্ষ করিয়াছেন কবি সংযম কাহাকে বলে জানিতেন না। রাজনৈতিক বহু নেতা এরূপ বহুবার অনশন-ব্রত অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা ছিলেন ত্যাগে অভ্যস্ত। কবির মতো একজন প্রাণ-চঞ্চল লোক কি করিয়া জেলের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া একাদিক্রমে চল্লিশ দিন অনাহারে কাটাইয়াছিলেন তাহা একেবারে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়। কিন্তু নজরুল জীবনের এই সময়টি এক মহামহিমার যুগ। কোনো অন্যায়ের সঙ্গেই মিটমাট করিয়া চলিবার পাত্র তিনি ছিলেন না। সেই সময়ে দেখিয়াছি, কত অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া তাঁহার দিন গিয়াছে। যদি একটু নরম হইয়া চলিতেন, যদি লোকের চাহিদা মতো কিছু লিখিতেন, তবে সম্মানের আর সম্পদের সিংহাসন আসিয়া তাঁহার পদতলে লুটাইত।

 

চলবে…..