০৩:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

দেশের সব অনাথাশ্রমে ‘হোপব’-এর মতো সচেতনতামূলক টুলকিট সম্প্রসারণ

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর, বি-র “অ্যাডভান্সিং সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস” (AdSEARCH) প্রকল্পের চারটি ক্ষেত্রভিত্তিক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরতে “Journey to Evidence: Series Dissemination of AdSEARCH Innovation – Round One” শীর্ষক সেমিনার ১ জানুয়ারি আইসিডিডিআর, বি-র সাসাকাওয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইসিডিডিআর, বি-র মাতৃ ও শিশু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. আনিসুর রহমান, এবং গবেষণা উপস্থাপন করেন একই বিভাগের সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানুর রহমান। সেমিনারে প্রধানত কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) সংক্রান্ত চারটি উদ্ভাবনী ধারণার কার্যকারিতা নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করা হয়।

হোপব: অনাথ কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি
গবেষক: ফারিয়া রহমান, রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, মাতৃ ও শিশু বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

অনাথ শিশুদের মধ্যে কিশোর-কিশোরী এক ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়। তাদের অনেকেই নিরাপদ পরিবেশ ও পরামর্শের অভাবে অনিরাপদ যৌন আচরণে জড়ায়, যার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়ে। বিভাগগুলোতে নিবন্ধিত প্রায় ১৭,৫০০ অনাথ কিশোরীর মধ্যে অর্ধেকই বিভিন্ন রকমের শোষণ ও নিপীড়নের শিকার।

এই প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয় ‘হোপব’ নামের একটি টুলকিট, যার উদ্দেশ্য অনাথ কিশোরীদের SRHR বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। হোপব-এ পাঁচটি চিত্র, তথ্যবই, পোস্টার এবং ধাঁধার মতো উপকরণ থাকায় ব্যবহারকারীরা সহজেই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মৌলিক ধারণা আয়ত্তে আনতে পারে। ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা ও ফরিদপুরের সরকারি অনাথ আশ্রমে ৮৭০০ জন অনাথ কিশোরী নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায়, হোপব প্রয়োগের ফলে:

  • নারী স্বাস্থ্যজাতীয় বিষয় নিয়ে সচেতনতার হার শতকরা ৪% থেকে ১১% বেড়ে হয় ৫১% থেকে ৫৯%।
  • কিশোরীরা ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্যবিধি, আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও তাদের অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করে।

গবেষণায় সুপারিশ করা হয়, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি অনাথ আশ্রমে হোপবের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করে কিশোরীদের জন্য SRHR সেবা সহজলভ্য করতে।

আইপাস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সৈয়দ বায়েত মন্তব্য করেন, “আমরা এখনও কিশোর-কিশোরীদের জন্য পর্যাপ্ত লিঙ্গ ও প্রজনন সেবা নিশ্চিত করতে পারছি না। বিশেষ করে অনাথ কিশোরীরা অনেক পিছিয়ে আছে। তাই তাদের জন্য ‘হোপব’-এর মতো একটি উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।”

মখুরিত: কিশোর-কিশোরীদের জন্য ডিজিটাল SRHR অ্যাপ
গবেষক: ড. হাসান রাশেক মাহমুদ, রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, মাতৃ ও শিশু বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

বাংলাদেশের জনসংখ্যায় কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ (৩ কোটি ৬০ লাখ)। তবুও তাদের অনেকেই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) বিষয়ক তথ্য ও সেবা থেকে বঞ্চিত। সম্প্রদায়ে এখনও এ নিয়ে ট্যাবু আছে, ফলে ভুল তথ্য, কৌতূহল এবং ভয়ে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করে। এই সমস্যা মোকাবিলায় তৈরি করা হয় ‘মখুরিত’ নামের আধুনিক একটি মোবাইল অ্যাপ, যেখানে কিশোর-কিশোরীরা সহজে SRHR সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারে, ভুল ধারণা দূর করতে পারে এবং প্রয়োজনমতো পরামর্শ পেতে পারে।

২০২৩ সালে ফেনীর তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (মেয়েদের, ছেলেদের ও মিশ্র) নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপর মখুরিত অ্যাপের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। এতে অংশ নেওয়া কিশোর-কিশোরীরা শুধু তথ্য আয়ত্ত করেনি, বরং একে অপরের সাথে আলোচনা করে স্বাভাবিকভাবে SRHR বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে উৎসাহিত হয়। গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায়:

  • SRHR ধারণা গঠনের স্কোর ৫.৭ থেকে বেড়ে হয় ৭.৫।
  • সচেতনতার স্কোর ৬.৬ থেকে বেড়ে হয় ৮.৭, যা ১৬% উন্নতি নির্দেশ করে।

একজন ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী বলেন, “মখুরিত অ্যাপ ব্যবহার করে আমি অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছি, যা আগে জানতাম না। এটা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।” গবেষকরা বলছেন, অ্যাপটির ব্যবহার কিশোরদের মধ্যে পারিবারিক আলোচনা এবং শিক্ষকের সহযোগিতায় জন্মনিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে সহজে কথা বলার পথ উন্মোচন করেছে।

ডা. মো. শামসুল হক (প্রোগ্রাম ম্যানেজার, Adolescent Health, DGHS) উল্লেখ করেন, “কিশোর-কিশোরীদের বয়স বিবেচনায় তথ্য সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি। এই কাজটি সফল করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। আমি মনে করি, ‘মখুরিত’ অ্যাপ এ ক্ষেত্রে পূর্ণ অবদান রাখতে পারে।”

ক্রীড়াবিদ কিশোরীদের ঋতুস্রাবকালীন অভিজ্ঞতা
গবেষক: ডা. মেহজাবিন তিশান মাহফুজ, সিনিয়র বিজ্ঞানী, পুষ্টি গবেষণা বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

মেধাবী ক্রীড়াবিদ কিশোরী-খেলোয়াড়দের জন্য মাসিককালীন স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে প্রভাবশালী নীতি থাকলেও, বাস্তবে সংস্থান-সহায়তা অনেকখানি পরিপূর্ণ নয়। এই ক্ষুদ্রতায় পুষ্টি, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির গুরুত্ব উপেক্ষিত হয়ে যায়, যা খেলোয়াড়দের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এই প্রেক্ষাপটে ইউথ লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (BKSP)-এ ১২–১৯ বছর বয়সী ১০০ জন নারী ক্রীড়াবিদকে নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়। জরুরি ফলাফলগুলো হচ্ছে:

  • ৬২% কিশোরী ঋতুস্রাবের আগে কোনো তথ্য পাননি, এবং ৮৬% মনে করেন তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া হয়নি।
  • অধিকাংশ কিশোরী (৮৮%) পরিবার থেকে, ৬১% কোচ বা শিক্ষক থেকে ঋতুস্রাব সংক্রান্ত তথ্য পান, অথচ বই, এমনকি মা থেকেও মাত্র ১১%–৫% তথ্য পেয়েছেন।
  • ৫৭% কিশোরী জানিয়েছেন, ঋতুস্রাবের সময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ পাননি, আর ৬৫% বাধ্য হয়েছেন কিছু শারীরিক কাজে বিরতি নিতে।
  • কারওই পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা ছিল না; প্রায় ৮০% মনে করেছেন তাদের টয়লেট ব্যবস্থা অপ্রতুল।

গবেষকরা বলছেন, এখনই সময় ক্রীড়া সংক্রান্ত নীতিতে ঋতুস্রাব-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করার। সামাজিক ট্যাবু ভেঙে আলোচনা শুরু, সচেতনতা কর্মসূচি, নারী চিকিৎসক নিয়োগ এবং কোচদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। এতে কিশোরী ক্রীড়াবিদদের পারফরম্যান্স অবারিত বাড়বে এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতিমালা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে।

আন্তর্জাতিক ক্রীড়া পরামর্শক অনুপম হোসেন যোগ করেন, “বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য প্রতিদিনই বাড়ছে। আমরা যদি তাদের প্রয়োজন মতো সহায়তা করতে পারি, তাহলে তাদের উন্নয়ন আরও সহজ ও গতিশীল হবে।” তিনি আইসিডিডিআর, বি-র এই উদ্যোগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের মধ্যে মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার
গবেষক: নাবিলা মাহমুদ, রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, পুষ্টি গবেষণা বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (RMG) শিল্প অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এতে প্রতিদিন লক্ষাধিক নারী কাজ করলেও, তাদের ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্য বিষয়কে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বিশেষ করে কর্মস্থলে নিরাপদ ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে নারীরা মানসিক ও শারীরিক অসুবিধার সম্মুখীন হন।

এই সমস্যা সমাধানে ‘মেনস্ট্রুয়াল কাপ’ (Reusable Menstrual Cup) প্রয়োগযোগ্য কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য ঢাকা ও গাজীপুরের পাঁচটি পোশাক কারখানায় ৮৫ জন নারীকে নিয়ে গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় দেখা যায়:

  • পুনঃব্যবহারযোগ্য মেডিকেল গ্রেড সিলিকন থেকে তৈরি এই কাপ ব্যবহার করে নারীরা মাসিককালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে আস্থা ফিরে পেয়েছেন।
  • কাপটি তাদের কর্মপরিবেশ এবং সংসার-কালীন টয়লেট সুবিধার সাথে মানিয়ে গেছে।
  • ফলস্বরূপ, রঙিন স্যানিটারি প্যাডের তুলনায় অর্থ সাশ্রয় করেছে এবং দেহেও আরাম বোধ করেছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন অধ্যক্ষণ সায়েবা আখতার মন্তব্য করেন, “যদি আমরা কিশোরী মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে না পারি, তাহলে সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন সম্ভব হবে না।”

গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার ফারজানা সুলতানা কানাডা সরকারের অব্যাহত সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। শেষে আইসিডিডিআর, বি-র অধিদপ্তরের ডিজি ডা. কামন নাহার ঘটনাটিকে সামাজিক গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানায়।

সেমিনারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর (DGFP), সমাজসেবা অধিদপ্তর (DSS) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকদের প্রতিনিধিসহ বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। তারা একাডেমিক ও কার্যনিবিড় আলোচনায় অংশ নিয়ে কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সৃষ্টির জন্য সম্মিলিত পরিকল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি
এই সেমিনার ও সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলোর পেছনে আইসিডিডিআর, বি এবং গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার দীর্ঘমেয়াদী সমর্থন রয়েছে। তারা কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য পরিবেশন ও সেবা একত্রে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। চারটি ক্ষেত্রভিত্তিক উদ্ভাবনই প্রমাণ করেছে যে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার অর্জনে সরাসরি এবং প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতির প্রয়োগ কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশব্যাপী এ ধরনের উদ্যোগ সম্প্রসারণের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও স্থানীয় সম্প্রদায়কেও একজোট করতে হবে, যাতে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যায়।

দেশের সব অনাথাশ্রমে ‘হোপব’-এর মতো সচেতনতামূলক টুলকিট সম্প্রসারণ

০৭:০০:৩৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর, বি-র “অ্যাডভান্সিং সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস” (AdSEARCH) প্রকল্পের চারটি ক্ষেত্রভিত্তিক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরতে “Journey to Evidence: Series Dissemination of AdSEARCH Innovation – Round One” শীর্ষক সেমিনার ১ জানুয়ারি আইসিডিডিআর, বি-র সাসাকাওয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইসিডিডিআর, বি-র মাতৃ ও শিশু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. আনিসুর রহমান, এবং গবেষণা উপস্থাপন করেন একই বিভাগের সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানুর রহমান। সেমিনারে প্রধানত কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) সংক্রান্ত চারটি উদ্ভাবনী ধারণার কার্যকারিতা নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ উপস্থাপন করা হয়।

হোপব: অনাথ কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি
গবেষক: ফারিয়া রহমান, রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, মাতৃ ও শিশু বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

অনাথ শিশুদের মধ্যে কিশোর-কিশোরী এক ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়। তাদের অনেকেই নিরাপদ পরিবেশ ও পরামর্শের অভাবে অনিরাপদ যৌন আচরণে জড়ায়, যার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়ে। বিভাগগুলোতে নিবন্ধিত প্রায় ১৭,৫০০ অনাথ কিশোরীর মধ্যে অর্ধেকই বিভিন্ন রকমের শোষণ ও নিপীড়নের শিকার।

এই প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয় ‘হোপব’ নামের একটি টুলকিট, যার উদ্দেশ্য অনাথ কিশোরীদের SRHR বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। হোপব-এ পাঁচটি চিত্র, তথ্যবই, পোস্টার এবং ধাঁধার মতো উপকরণ থাকায় ব্যবহারকারীরা সহজেই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত মৌলিক ধারণা আয়ত্তে আনতে পারে। ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা ও ফরিদপুরের সরকারি অনাথ আশ্রমে ৮৭০০ জন অনাথ কিশোরী নিয়ে গবেষণা করে দেখা যায়, হোপব প্রয়োগের ফলে:

  • নারী স্বাস্থ্যজাতীয় বিষয় নিয়ে সচেতনতার হার শতকরা ৪% থেকে ১১% বেড়ে হয় ৫১% থেকে ৫৯%।
  • কিশোরীরা ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্যবিধি, আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও তাদের অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করে।

গবেষণায় সুপারিশ করা হয়, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি অনাথ আশ্রমে হোপবের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করে কিশোরীদের জন্য SRHR সেবা সহজলভ্য করতে।

আইপাস বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সৈয়দ বায়েত মন্তব্য করেন, “আমরা এখনও কিশোর-কিশোরীদের জন্য পর্যাপ্ত লিঙ্গ ও প্রজনন সেবা নিশ্চিত করতে পারছি না। বিশেষ করে অনাথ কিশোরীরা অনেক পিছিয়ে আছে। তাই তাদের জন্য ‘হোপব’-এর মতো একটি উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।”

মখুরিত: কিশোর-কিশোরীদের জন্য ডিজিটাল SRHR অ্যাপ
গবেষক: ড. হাসান রাশেক মাহমুদ, রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, মাতৃ ও শিশু বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

বাংলাদেশের জনসংখ্যায় কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ (৩ কোটি ৬০ লাখ)। তবুও তাদের অনেকেই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) বিষয়ক তথ্য ও সেবা থেকে বঞ্চিত। সম্প্রদায়ে এখনও এ নিয়ে ট্যাবু আছে, ফলে ভুল তথ্য, কৌতূহল এবং ভয়ে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করে। এই সমস্যা মোকাবিলায় তৈরি করা হয় ‘মখুরিত’ নামের আধুনিক একটি মোবাইল অ্যাপ, যেখানে কিশোর-কিশোরীরা সহজে SRHR সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারে, ভুল ধারণা দূর করতে পারে এবং প্রয়োজনমতো পরামর্শ পেতে পারে।

২০২৩ সালে ফেনীর তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (মেয়েদের, ছেলেদের ও মিশ্র) নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপর মখুরিত অ্যাপের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। এতে অংশ নেওয়া কিশোর-কিশোরীরা শুধু তথ্য আয়ত্ত করেনি, বরং একে অপরের সাথে আলোচনা করে স্বাভাবিকভাবে SRHR বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে উৎসাহিত হয়। গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায়:

  • SRHR ধারণা গঠনের স্কোর ৫.৭ থেকে বেড়ে হয় ৭.৫।
  • সচেতনতার স্কোর ৬.৬ থেকে বেড়ে হয় ৮.৭, যা ১৬% উন্নতি নির্দেশ করে।

একজন ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী বলেন, “মখুরিত অ্যাপ ব্যবহার করে আমি অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছি, যা আগে জানতাম না। এটা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।” গবেষকরা বলছেন, অ্যাপটির ব্যবহার কিশোরদের মধ্যে পারিবারিক আলোচনা এবং শিক্ষকের সহযোগিতায় জন্মনিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে সহজে কথা বলার পথ উন্মোচন করেছে।

ডা. মো. শামসুল হক (প্রোগ্রাম ম্যানেজার, Adolescent Health, DGHS) উল্লেখ করেন, “কিশোর-কিশোরীদের বয়স বিবেচনায় তথ্য সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি। এই কাজটি সফল করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। আমি মনে করি, ‘মখুরিত’ অ্যাপ এ ক্ষেত্রে পূর্ণ অবদান রাখতে পারে।”

ক্রীড়াবিদ কিশোরীদের ঋতুস্রাবকালীন অভিজ্ঞতা
গবেষক: ডা. মেহজাবিন তিশান মাহফুজ, সিনিয়র বিজ্ঞানী, পুষ্টি গবেষণা বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

মেধাবী ক্রীড়াবিদ কিশোরী-খেলোয়াড়দের জন্য মাসিককালীন স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে প্রভাবশালী নীতি থাকলেও, বাস্তবে সংস্থান-সহায়তা অনেকখানি পরিপূর্ণ নয়। এই ক্ষুদ্রতায় পুষ্টি, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির গুরুত্ব উপেক্ষিত হয়ে যায়, যা খেলোয়াড়দের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এই প্রেক্ষাপটে ইউথ লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (BKSP)-এ ১২–১৯ বছর বয়সী ১০০ জন নারী ক্রীড়াবিদকে নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়। জরুরি ফলাফলগুলো হচ্ছে:

  • ৬২% কিশোরী ঋতুস্রাবের আগে কোনো তথ্য পাননি, এবং ৮৬% মনে করেন তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া হয়নি।
  • অধিকাংশ কিশোরী (৮৮%) পরিবার থেকে, ৬১% কোচ বা শিক্ষক থেকে ঋতুস্রাব সংক্রান্ত তথ্য পান, অথচ বই, এমনকি মা থেকেও মাত্র ১১%–৫% তথ্য পেয়েছেন।
  • ৫৭% কিশোরী জানিয়েছেন, ঋতুস্রাবের সময় পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ পাননি, আর ৬৫% বাধ্য হয়েছেন কিছু শারীরিক কাজে বিরতি নিতে।
  • কারওই পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা ছিল না; প্রায় ৮০% মনে করেছেন তাদের টয়লেট ব্যবস্থা অপ্রতুল।

গবেষকরা বলছেন, এখনই সময় ক্রীড়া সংক্রান্ত নীতিতে ঋতুস্রাব-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করার। সামাজিক ট্যাবু ভেঙে আলোচনা শুরু, সচেতনতা কর্মসূচি, নারী চিকিৎসক নিয়োগ এবং কোচদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। এতে কিশোরী ক্রীড়াবিদদের পারফরম্যান্স অবারিত বাড়বে এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতিমালা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে।

আন্তর্জাতিক ক্রীড়া পরামর্শক অনুপম হোসেন যোগ করেন, “বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য প্রতিদিনই বাড়ছে। আমরা যদি তাদের প্রয়োজন মতো সহায়তা করতে পারি, তাহলে তাদের উন্নয়ন আরও সহজ ও গতিশীল হবে।” তিনি আইসিডিডিআর, বি-র এই উদ্যোগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের মধ্যে মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার
গবেষক: নাবিলা মাহমুদ, রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর, পুষ্টি গবেষণা বিভাগ, আইসিডিডিআর, বি
সমর্থন: গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা (GAC)

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (RMG) শিল্প অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এতে প্রতিদিন লক্ষাধিক নারী কাজ করলেও, তাদের ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্য বিষয়কে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বিশেষ করে কর্মস্থলে নিরাপদ ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে নারীরা মানসিক ও শারীরিক অসুবিধার সম্মুখীন হন।

এই সমস্যা সমাধানে ‘মেনস্ট্রুয়াল কাপ’ (Reusable Menstrual Cup) প্রয়োগযোগ্য কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য ঢাকা ও গাজীপুরের পাঁচটি পোশাক কারখানায় ৮৫ জন নারীকে নিয়ে গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় দেখা যায়:

  • পুনঃব্যবহারযোগ্য মেডিকেল গ্রেড সিলিকন থেকে তৈরি এই কাপ ব্যবহার করে নারীরা মাসিককালীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে আস্থা ফিরে পেয়েছেন।
  • কাপটি তাদের কর্মপরিবেশ এবং সংসার-কালীন টয়লেট সুবিধার সাথে মানিয়ে গেছে।
  • ফলস্বরূপ, রঙিন স্যানিটারি প্যাডের তুলনায় অর্থ সাশ্রয় করেছে এবং দেহেও আরাম বোধ করেছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন অধ্যক্ষণ সায়েবা আখতার মন্তব্য করেন, “যদি আমরা কিশোরী মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে না পারি, তাহলে সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন সম্ভব হবে না।”

গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার ফারজানা সুলতানা কানাডা সরকারের অব্যাহত সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। শেষে আইসিডিডিআর, বি-র অধিদপ্তরের ডিজি ডা. কামন নাহার ঘটনাটিকে সামাজিক গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করে ধন্যবাদ জানায়।

সেমিনারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (DGHS), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর (DGFP), সমাজসেবা অধিদপ্তর (DSS) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকদের প্রতিনিধিসহ বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। তারা একাডেমিক ও কার্যনিবিড় আলোচনায় অংশ নিয়ে কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সৃষ্টির জন্য সম্মিলিত পরিকল্পনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি
এই সেমিনার ও সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলোর পেছনে আইসিডিডিআর, বি এবং গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার দীর্ঘমেয়াদী সমর্থন রয়েছে। তারা কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য পরিবেশন ও সেবা একত্রে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। চারটি ক্ষেত্রভিত্তিক উদ্ভাবনই প্রমাণ করেছে যে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার অর্জনে সরাসরি এবং প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতির প্রয়োগ কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশব্যাপী এ ধরনের উদ্যোগ সম্প্রসারণের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও স্থানীয় সম্প্রদায়কেও একজোট করতে হবে, যাতে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যায়।