০৮:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
“ওরা করলে, আমরা প্রস্তুত”: পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা ইস্যুতে রাজনাথ সিংয়ের হুঁশিয়ারি বেঙ্গালুরুর জেলে আইএস জঙ্গি ও সিরিয়াল ধর্ষকের মোবাইল ব্যবহার ফাঁস, তদন্তে নেমেছে কর্ণাটক সরকার পাকিস্তানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের অভূতপূর্ব পদোন্নতি — এখন দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ বর্তমানের সব জাতীয় সংকটই সরকারের সাজানো নাটক: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা ও ট্যারিফ বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশিতে আদানি পাওয়ার” ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে আধুনিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর নতুন বেতন কমিশন গঠন করবে পরবর্তী সরকার: সালেহউদ্দিন আহমেদ নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পাঁচ মামলায় জামিন প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিতে সহানুভূতির আহ্বান জানালেন জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পারওয়ার বর্তমান ইন্টারিম সরকার আমলে আইএমএফ পরবর্তী কিস্তি ঋণ দেবে না

মমতাজউদ্দীন আহমদ: নাট্যজগতের এক সংগ্রামী পুরুষ

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যে কজন মানুষ নিজের চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং কর্মের মাধ্যমে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন, মমতাজউদ্দীন আহমদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন নাট্যকার, শিক্ষক, অভিনেতা ও সর্বোপরি এক অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ। তাঁর জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে একজন মানুষ সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় নিজেকে নিবেদিত করে সমাজের জাগরণে ভূমিকা রাখতে পারেন।

মমতাজউদ্দীনের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। যখন দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে, তখন তিনি ছিলেন শব্দ ও ভাষার যোদ্ধা। চট্টগ্রামে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর কণ্ঠ ও কলম মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন অস্ত্র ও শব্দের সম্মিলনে বাস্তব হয়ে উঠছিল। নাটক ও আবৃত্তির মাধ্যমে তিনি যে সাহসিকতা ও উদ্দীপনার বার্তা ছড়িয়েছিলেন, তা আজও অনুপ্রেরণার উৎস।

তাঁর নাট্যজীবনের সূচনা মঞ্চনাটক দিয়ে, এবং এ ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। ষাটের দশক থেকে শুরু করে জীবনের শেষপর্যন্ত তিনি নাটক রচনা ও মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের অসংগতিগুলো তুলে ধরেছেন। তাঁর নাটক ‘কি চাহ শঙ্খচিল’, ‘রাজার মতো রাজা’, ‘মহুয়া’ কিংবা ‘নজরুল’ শুধু নাট্যশিল্প নয়, সময়ের দর্পণ হিসেবেও বিবেচিত হয়। মমতাজউদ্দীনের নাটকে আমরা দেখতে পাই এক তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক সচেতনতা, গভীর মানবিক বোধ এবং রূপক-প্রতীকের অভিনব প্রয়োগ। তাঁর নাট্যভাষা ছিল কবিতার মতো সজীব, আবার বক্তব্য ছিল দৃঢ় ও সংগ্রামী।

তবে মঞ্চেই তাঁর প্রতিভা সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণযুগে তিনি ছিলেন নিয়মিত মুখ। টিভি নাটকে তাঁর অভিনয় ছিল এক ধরনের আত্মস্থ প্রকাশ—জটিল চরিত্রেও সহজতা, এবং সহজ চরিত্রেও গভীরতা আনতেন তিনি। তেমনি চলচ্চিত্রেও তাঁর অবদান ছিল সযত্ন এবং বেছে নেওয়া, যেখানে প্রতিটি ভূমিকায় ছিল তাঁর নিজস্ব মুদ্রাদোষহীন অভিনয়ের ছাপ।

শিক্ষকতা ছিল মমতাজউদ্দীনের আরেকটি পরিচয়, যেখানে তিনি নিজের চিন্তাভাবনা ও আদর্শ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষাপীঠে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তাঁর ক্লাস ছিল নাট্যশিল্পের পাঠশালা, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, নাট্যরীতি, নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য ও রাজনীতি—সবকিছুর সংমিশ্রণে এক জাগ্রত চিন্তার ভেতর প্রবেশ করত। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন রূঢ় নন, বরং গভীর আন্তরিক ও মুক্তচিন্তার অনুরাগী। তাঁর ছাত্ররা তাঁকে মনে রাখে একজন আলো ছড়ানো মানুষ হিসেবে।

মমতাজউদ্দীনের নাট্যচিন্তা সবসময়ই প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির পক্ষে। তিনি ছিলেন ধর্মান্ধতার বিরোধী, এবং সামাজিক ভণ্ডামির কড়া সমালোচক। নাটকে তিনি যে সমাজচিত্র এঁকেছেন, তাতে উচ্চবর্ণের শোষণ, রাজনৈতিক দুর্নীতি, এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তিনি চাইতেন এমন এক নাটক, যা দর্শককে শুধু বিনোদিত করবে না, বরং চিন্তায় নাড়া দেবে, প্রতিবাদে উসকে দেবে।

তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একুশে পদকসহ বহু জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন, হয়তো এই যে, তিনি নাটককে বইয়ের পাতা কিংবা থিয়েটারের মঞ্চ থেকে টেনে এনেছেন বাস্তব জীবনের কাছে, সাধারণ মানুষের হৃদয়ে।

মমতাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্ম থেকে আমরা শিখি যে, একজন শিল্পী শুধু সৃষ্টিশীল হলেই যথেষ্ট নয়—তাঁকে হতে হয় সমাজের দর্পণ, সময়ের ভাষ্যকার, এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তিনি ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি নিজের চিন্তা, ভাষা ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে তার সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দিকে তাকাতে শিখিয়েছেন।

মৃত্যুর পরও তিনি রয়ে গেছেন আমাদের নাট্যচর্চায়, চিন্তায় এবং স্বপ্নে—যেখানে স্বাধীনতা মানে কেবল ভূখণ্ড নয়, বরং চিন্তার মুক্তিও।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

“ওরা করলে, আমরা প্রস্তুত”: পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা ইস্যুতে রাজনাথ সিংয়ের হুঁশিয়ারি

মমতাজউদ্দীন আহমদ: নাট্যজগতের এক সংগ্রামী পুরুষ

১১:৪৫:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যে কজন মানুষ নিজের চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং কর্মের মাধ্যমে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছেন, মমতাজউদ্দীন আহমদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন নাট্যকার, শিক্ষক, অভিনেতা ও সর্বোপরি এক অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ। তাঁর জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে একজন মানুষ সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় নিজেকে নিবেদিত করে সমাজের জাগরণে ভূমিকা রাখতে পারেন।

মমতাজউদ্দীনের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। যখন দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে, তখন তিনি ছিলেন শব্দ ও ভাষার যোদ্ধা। চট্টগ্রামে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই তাঁর কণ্ঠ ও কলম মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন অস্ত্র ও শব্দের সম্মিলনে বাস্তব হয়ে উঠছিল। নাটক ও আবৃত্তির মাধ্যমে তিনি যে সাহসিকতা ও উদ্দীপনার বার্তা ছড়িয়েছিলেন, তা আজও অনুপ্রেরণার উৎস।

তাঁর নাট্যজীবনের সূচনা মঞ্চনাটক দিয়ে, এবং এ ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। ষাটের দশক থেকে শুরু করে জীবনের শেষপর্যন্ত তিনি নাটক রচনা ও মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের অসংগতিগুলো তুলে ধরেছেন। তাঁর নাটক ‘কি চাহ শঙ্খচিল’, ‘রাজার মতো রাজা’, ‘মহুয়া’ কিংবা ‘নজরুল’ শুধু নাট্যশিল্প নয়, সময়ের দর্পণ হিসেবেও বিবেচিত হয়। মমতাজউদ্দীনের নাটকে আমরা দেখতে পাই এক তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক সচেতনতা, গভীর মানবিক বোধ এবং রূপক-প্রতীকের অভিনব প্রয়োগ। তাঁর নাট্যভাষা ছিল কবিতার মতো সজীব, আবার বক্তব্য ছিল দৃঢ় ও সংগ্রামী।

তবে মঞ্চেই তাঁর প্রতিভা সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণযুগে তিনি ছিলেন নিয়মিত মুখ। টিভি নাটকে তাঁর অভিনয় ছিল এক ধরনের আত্মস্থ প্রকাশ—জটিল চরিত্রেও সহজতা, এবং সহজ চরিত্রেও গভীরতা আনতেন তিনি। তেমনি চলচ্চিত্রেও তাঁর অবদান ছিল সযত্ন এবং বেছে নেওয়া, যেখানে প্রতিটি ভূমিকায় ছিল তাঁর নিজস্ব মুদ্রাদোষহীন অভিনয়ের ছাপ।

শিক্ষকতা ছিল মমতাজউদ্দীনের আরেকটি পরিচয়, যেখানে তিনি নিজের চিন্তাভাবনা ও আদর্শ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষাপীঠে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তাঁর ক্লাস ছিল নাট্যশিল্পের পাঠশালা, যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, নাট্যরীতি, নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য ও রাজনীতি—সবকিছুর সংমিশ্রণে এক জাগ্রত চিন্তার ভেতর প্রবেশ করত। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন রূঢ় নন, বরং গভীর আন্তরিক ও মুক্তচিন্তার অনুরাগী। তাঁর ছাত্ররা তাঁকে মনে রাখে একজন আলো ছড়ানো মানুষ হিসেবে।

মমতাজউদ্দীনের নাট্যচিন্তা সবসময়ই প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির পক্ষে। তিনি ছিলেন ধর্মান্ধতার বিরোধী, এবং সামাজিক ভণ্ডামির কড়া সমালোচক। নাটকে তিনি যে সমাজচিত্র এঁকেছেন, তাতে উচ্চবর্ণের শোষণ, রাজনৈতিক দুর্নীতি, এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তিনি চাইতেন এমন এক নাটক, যা দর্শককে শুধু বিনোদিত করবে না, বরং চিন্তায় নাড়া দেবে, প্রতিবাদে উসকে দেবে।

তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একুশে পদকসহ বহু জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন, হয়তো এই যে, তিনি নাটককে বইয়ের পাতা কিংবা থিয়েটারের মঞ্চ থেকে টেনে এনেছেন বাস্তব জীবনের কাছে, সাধারণ মানুষের হৃদয়ে।

মমতাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্ম থেকে আমরা শিখি যে, একজন শিল্পী শুধু সৃষ্টিশীল হলেই যথেষ্ট নয়—তাঁকে হতে হয় সমাজের দর্পণ, সময়ের ভাষ্যকার, এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তিনি ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি নিজের চিন্তা, ভাষা ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে তার সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দিকে তাকাতে শিখিয়েছেন।

মৃত্যুর পরও তিনি রয়ে গেছেন আমাদের নাট্যচর্চায়, চিন্তায় এবং স্বপ্নে—যেখানে স্বাধীনতা মানে কেবল ভূখণ্ড নয়, বরং চিন্তার মুক্তিও।