বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে “রুটিন” আখ্যা দিয়ে শীর্ষ ব্যবসায়ী, পরিকল্পনাবিদ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছেন—এই বাজেট রপ্তানি-বৃদ্ধি ও শিল্প-উৎপাদনের জন্য জরুরি কাঠামোগত সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এলডিসি উত্তরণের ঠিক আগে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
শিল্পপতিদের সরাসরি হুঁশিয়ারি
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী মনে করেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন ও নতুন তিনটি বন্দরের সমমানের উন্নয়ন, অপ্রতিরোধ্য বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ এবং এক শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স প্রত্যাহার—এই তিনটি পদক্ষেপ ছাড়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও রপ্তানিমুখী শিল্প দাঁড়াতে পারবে না।” তিনি ৯০ দিনের জরুরি কর্মপরিকল্পনা বাজেটে দেখতে চেয়েছিলেন, যা অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
রপ্তানি নির্ভরতা: এক ঝুঁকির ওপর ৮০ শতাংশ
আজও তৈরি-পোশাক (আরএমজি) একাই দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি নিয়ে যায়, যা দামে ওঠা-নামা ও বাজার পাল্টানোর ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলতায় বাধা ও নতুন ট্যারিফের শক-ঝড়ে এই একক নির্ভরতা বড় ধাক্কা খেতে পারে।
লজিস্টিক্সের সূচকে পিছিয়ে
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক ‘কানেক্টিং টু কম্পিট ২০২৩’ প্রতিবেদনে ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের লজিস্টিক পারফরম্যান্স সূচক (এলপিআই) স্কোর মাত্র ২.৬; অবস্থান ৮৮তম। ধীর কাস্টমস, দুর্বল অবকাঠামো ও ট্র্যাক-অ্যান্ড-ট্রেস ব্যবস্থার ঘাটতি পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। অর্থাৎ পণ্য বানালেও দ্রুত ও কম খরচে বিশ্ববাজারে পৌঁছাতে পারছে না বাংলাদেশ।
‘লক্ষ্য আছে, পদক্ষেপ নেই’—সিপিডি
বাজেটের উদ্দেশ্য ইতিবাচক হলেও বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট উপায় নেই বলে মত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর। সংস্থাটির মতে, প্রতিশ্রুত সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বা বৈষম্য ঘোচাতে যে নীতি বলা হয়েছে, তা পূরণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সংস্কারপন্থী করনীতি অনুপস্থিত। তাদের বিশ্লেষণে, এক শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স এসএমইদের কার্যকর করহার ১০ শতাংশের ওপর তুলে দিচ্ছে, যা রপ্তানি-মুখী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য “অবিচারসুলভ”।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সতর্ক বার্তা
২০২৩ সালের আর্টিকেল IV পর্যালোচনায় আইএমএফ স্পষ্ট করে বলেছে—বাণিজ্য উদারীকরণ ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি ছাড়া রপ্তানি বৈচিত্র্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে না। বাজেটে শুল্ক-কোটার সুরক্ষা কিছুটা কমানো হলেও ‘সিঙ্গেল-উইন্ডো’ বা অনলাইন ল্যান্ড পোর্টাল চালুর মতো কাঠামোগত সংস্কারের খসড়া অনুপস্থিত।
পাঁচটি তাৎক্ষণিক সংস্কার পরামর্শ
১) ৯০ দিনের অ্যাকশন প্ল্যান—বন্দর, কাস্টমস ও গ্যাস সংযোগে নির্দিষ্ট টাইমলাইন প্রকাশ।
২) সিঙ্গেল-উইন্ডো সার্ভিস—রপ্তানি ও আমদানি ছাড়পত্রের কাগুজে প্রক্রিয়া এক প্ল্যাটফর্মে আনা।
৩) শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস—স্থানীয় বাজার সুরক্ষার বদলে বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনে অংশগ্রহণকে পুরস্কৃত করা।
৪) শক্তি নিরাপত্তা—স্পট এলএনজি-নির্ভরতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস চুক্তি ও নবায়নযোগ্য উৎসে তহবিল বাড়ানো।
৫) করজাল সম্প্রসারণ ও টার্নওভার ট্যাক্স পর্যালোচনা—লভ্যাংশের ওপর করকে কেন্দ্রীয় করা, বিক্রয়ের ওপর নয়।
বাজেটের ঘাটতি বা মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেওয়া একটি বাস্তবতা; তবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানি-ভিত্তিক উৎপাদনে কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া পথ নেই। আন্তর্জাতিক সূচক, আইএমএফের শর্ত ও দেশীয় ব্যবসায়ীদের একক স্বর—সবই একই বার্তা দিচ্ছে: বহুমুখী রপ্তানি ও দক্ষ লজিস্টিক্স না থাকলে এলডিসি-উত্তর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সঙ্কুচিত হবে, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও সীমিত হয়ে পড়বে। এখনই সাহসী পদক্ষেপ নিলে বাজেট সত্যিকার অর্থে উৎপাদন-বান্ধব ও রপ্তানি-স্থিতিশীল হতে পারে—আর না হলে ‘রুটিন বাজেট’-এর সীমানা বেঁধে দেবে আগামীর প্রবৃদ্ধি।