যুদ্ধের ছায়ায় অর্থনৈতিক অস্থিরতা
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে ‘বিপুল সামরিক সাফল্য’ বলে আখ্যায়িত করলেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে তেলের দামে সম্ভাব্য ঊর্ধ্বগতি এবং নিরাপদ সম্পদে বিনিয়োগের প্রবণতা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ট্রাম্পের ঘোষণার পর ইরানের হুঁশিয়ারি
টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেন, “ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও জানান, ইরান যদি শান্তির পথে না আসে, তাহলে আরও লক্ষ্যবস্তুতে হামলার প্রস্তুতি রয়েছে।
জবাবে ইরান বলেছে, তারা আত্মরক্ষার জন্য সব বিকল্প খোলা রেখেছে এবং এর ‘চিরস্থায়ী পরিণতি’ হতে পারে বলে সতর্ক করেছে।
বাজারে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জড়িয়ে পড়া বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। পোটোম্যাক রিভার ক্যাপিটালের বিনিয়োগ প্রধান মার্ক স্পিনডেল বলেন, “বাজারে আতঙ্ক দেখা দিতে পারে এবং তেলের দাম বাড়বে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা এখনও ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণ চিত্র জানি না, ফলে অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা বাজারকে ঘিরে থাকবে।”
ক্রিপ্টো বাজারে পতন, উপসাগরীয় শেয়ারবাজারে স্থিতি
ইথার (ether) নামক ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম ৫ শতাংশ কমে গেছে, যা ১৩ জুন থেকে মোট ১৩ শতাংশ পতন। এটি খুচরা বিনিয়োগকারীদের মনোভাবের সূচক হিসেবে বিবেচিত।
তবে কাতার, সৌদি আরব ও কুয়েতের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন দেখা যায়নি, বরং কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাই ছিল। ইসরায়েলের তেল আবিব সূচকও সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে।
তেলের দাম ও মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনায় নতুন করে মূল্যস্ফীতির ভয় সৃষ্টি হয়েছে। সিডনি-ভিত্তিক বিশ্লেষক সল কাভনিক বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বা উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। বিশেষত হরমুজ প্রণালীকে ঘিরে অস্থিরতা বাড়তে পারে, যা সৌদি আরব, আমিরাত, ইরাক এবং কুয়েতের তেল রপ্তানির প্রধান রুট।
তিনি বলেন, “সবকিছু নির্ভর করছে ইরান কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে তারা পূর্বের মতো প্রতিক্রিয়া দেখালে তেলের দাম ১০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।”
ব্রেন্ট তেলের দাম ১০ জুন থেকে প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়ে বৃহস্পতিবার ৭৯.০৪ ডলারে পৌঁছেছে, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা?
হ্যারিস ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের জেমি কক্স বলেন, এই হামলার পর ইরান তাদের পারমাণবিক ক্ষমতা হারিয়েছে এবং তারা এখন হয়তো শান্তিচুক্তির দিকে ঝুঁকবে। “তাদের প্রভাব বা ‘লিভারেজ’ এখন আর নেই,”— বলেন কক্স।
তবে কিছু অর্থনীতিবিদ সতর্ক করছেন, যদি তেলের দাম নাটকীয়ভাবে বাড়ে, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, যা ইতোমধ্যে ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে চাপে আছে।
ইতিহাস যা বলে
তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেলেও মার্কিন শেয়ারবাজারে প্রাথমিক পতনের পর দ্রুত পুনরুদ্ধার ঘটে। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ এবং ২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার পর একই ধরনের প্রবণতা দেখা গিয়েছিল।
ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের তথ্য অনুযায়ী, উত্তেজনার শুরু থেকে তিন সপ্তাহে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক গড়ে ০.৩ শতাংশ কমলেও দুই মাসের মাথায় তা গড়ে ২.৩ শতাংশ বেড়েছিল।
ডলারের ভবিষ্যৎ
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, মার্কিন ডলার নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সাময়িকভাবে শক্তিশালী হতে পারে, যদিও চলতি বছরে তা দুর্বলতার ইঙ্গিত দিয়েছে। আইবিকেআরের প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ সোসনিক বলেন, “যদি নিরাপদ আশ্রয়ে পুঁজি চলে আসে, তাহলে ডলারের শক্তি বাড়বে এবং সুদের হারে পতন ঘটবে।”
সবকিছু এখন নির্ভর করছে ইরানের প্রতিক্রিয়ার ওপর—তারা কীভাবে জবাব দেয়, আর তেল বাজারে কতটা প্রতিক্রিয়া আসে, সেটাই মূল প্রশ্ন।