০৯:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া উনসানে সমুদ্র সৈকতের রিসোর্ট উদ্বোধন: পর্যটনে বাজি ধরছে উত্তর কোরিয়া ওএমএস ও টিসিবি ডিলার নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান এসএসসি টেস্টের দুই দিনে শ্রীলঙ্কার রাজত্ব রাসেল ভাইপারের হুমকি: শহরেও ঢুকছে বিপজ্জনক সাপ! মঙ্গল অভিযানের প্রস্তুতি: মহাকাশে পাঠানো হলো গাঁজা গাছের বীজ ২০২৫ সালের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আইসল্যান্ড, শীর্ষ দশে সিঙ্গাপুর নৌকার বাংলাদেশ: জেলা-জেলা ঘিরে এক ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বা পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কী? কীভাবে এটি করা হয়? নেতানিয়াহুর বিচার বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের

খাদ্য, বিজ্ঞান ও সমাজ: একেকটি স্বাদের গভীর বার্তা

জাপানে ভারতীয় খাবারের ভিন্নতা

২০১৪ সালে প্রথম জাপান সফরের সময় ত্রিশিত ব্যানার্জি যতটা না বিস্মিত হয়েছিলেন কাঁচা মাছ আর ভিনেগারযুক্ত চাল খেয়ে, তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলেন বিশাল সাইজের নান দেখে। সেই রুটি, উজ্জ্বল লাল রঙের মাখন-মুরগির তরকারির সঙ্গে, তাঁর কাছে ভারতীয় খাবারের অদ্ভুত এক সংস্করণ মনে হয়েছিল।

২০১৫ সালে তিনি জাপানে এসে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে পড়েন। এখানে ভারতীয় খাবারের প্রচলিত রূপ তাঁর কাছে একেবারেই অপরিচিত ছিল। অথচ বাড়িতে মা প্রতিদিনের খাবার সাজাতেন তিন ধাপে — প্রথমে ঘি ও লবণ দিয়ে ভাত বা ভাজা সবজির খোসা, এরপর মাছের মাথা দিয়ে ডাল ও ভাজি, এবং সবশেষে রুই/কাতলা মাছের তরকারি, টক-মিষ্টি টমেটোর চাটনি ও মিষ্টি।

এই বিশ্লেষণধর্মী খাবার প্রস্তুতির পেছনে মায়ের মনোযোগ ছিল বিজ্ঞানভাবনার ভিত্তি। এর থেকেই তাঁর গবেষণার পথ তৈরি হয়।

গবেষণায় একক অনু ও আত্মোপলব্ধি

স্নাতক শেষ করে ব্যানার্জি ডিএনএ-যুক্ত প্রোটিন নিয়ে পিএইচডি গবেষণায় যোগ দেন। গবেষণায় দুটি পদ্ধতি রয়েছে — একটি হলো ‘এনসেম্বল’ পদ্ধতি, যেখানে অনেক অনুর গড় তথ্য নেওয়া হয়, আর অন্যটি ‘সিঙ্গল-মলিকিউল’ পদ্ধতি, যেখানে প্রতিটি অনুকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাঁর গবেষণাগার দ্বিতীয় পদ্ধতিকে অনুসরণ করে।

প্রথম বছরটা তাঁর কেটেছে অন্ধকার ঘরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একক অনু পর্যবেক্ষণ করে, কোনো ফলাফল ছাড়াই। তবে একবার সফল হলে যে আনন্দ, তার তুলনা নেই।

সমাজের সঙ্গে সংযোগ: ফুকুশিমার পথে

ক্যাম্পাসের বাইরের জগতে যুক্ত হওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালে সেনদাইয়ে আসার পর তিনি তোহোকু অঞ্চলের পর্যটন পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় যুক্ত হন। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় ফুকুশিমার ফুতাবা শহরে কাজ করা ইয়ামানে তাতসুহিরোর সঙ্গে। পরে তিনি ফুতাবা এরিয়া ট্যুরিজম রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনে (F-ATRAs) যোগ দেন এবং শহরের ইতিহাস, সংস্কৃতি নিয়ে হাঁটার ট্যুর আয়োজন করেন।

২০২৩ সালে জাপান যখন প্রক্রিয়াজাত পানি প্রশান্ত মহাসাগরে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বৈজ্ঞানিক তথ্য নিয়ে যত না আপত্তি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল বিশ্বাসের সংকট। এখনো ফুকুশিমা অনেকের কাছে আতঙ্কের নাম।

তাই স্থানীয়দের নিয়ে ইতিবাচক গল্প তৈরি এবং বিশ্বাস পুনর্গঠনই তাঁর কাজের মূল লক্ষ্য।

রান্নাঘরে সমাজের ভাষা

২০২৪ সালের বসন্তে ব্যানার্জি একটি প্রাতিষ্ঠানিক নৈশভোজ আয়োজন করেন, যেখানে তিনি ভারতীয় খাবারকে মাল্টিকোর্স আকারে পরিবেশন করেন। একটি ডিশ ছিল ‘শাহী কোরমা’, যা তাজমহলের উদ্বোধনে পরিবেশিত হতো এমন একটি সাদা কারি। তবে তিনি জানতেন, জাপানিদের অনেকেই ধনেপাতার স্বাদ অপছন্দ করেন। তাই তিনি এর পরিবর্তে ব্যবহার করেন স্থানীয় ‘হাবানোরি’ সামুদ্রিক শৈবাল, যা খাবারে গভীরতা আনে এবং বাদাম-দইয়ের কোরমার সঙ্গে মিশে যায়। এটা একই বার্তা — ভিন্ন ভাষায় বলা।

জাতিও একধরনের এনসেম্বল

একক অনু পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে, বড় কাঠামোকে বোঝার জন্য ছোট উপাদান বুঝতে হয়। যেমন, গণতন্ত্রও অনেক সময় কেবল গড় মতামত প্রকাশ করে। কিন্তু ‘জাতি’ গঠনের পেছনে থাকে হাজারো ছোট ছোট গল্প, স্থানিক ইতিহাস, সংস্কৃতি। এই ভাবনাই তাঁকে নিজের আশপাশের মানুষ, ছোট শহর, রান্না — সবকিছুকে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়।

বিজ্ঞানখাদ্য ও প্রেম: ধৈর্যের উপাখ্যান

২০২৪ সালের শরতে তিনি সেনদাই থেকে নামিয়ে শহরে চলে যান। সেখানে তিনি নতুন বছরের জন্য ‘ওসেচি রিয়োরি’ (নববর্ষের খাবার) বানান। এর মধ্যে ছিল সেনদাইয়ের কুয়াই (কচুরমূলো) এবং নামিয়ে শহরের হিজুনামাসু (স্যালমনের মাথার তরল অংশ ও মূলা) — যা তাঁর জাপানি জীবনের দুটি স্তম্ভকে একত্র করে।

এছাড়া তিনি শৈশবের টমেটো চাটনিও নতুনভাবে তৈরি করেন, যেখানে লেবুর রসের বদলে ব্যবহার করেন ‘ইউজু’ খোসা। এই বসন্তে তিনি নিজেই তৈরি করেন কোজি — জাপানের বিখ্যাত ছাঁচ যা সাকে ও মিসো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

তাঁর ভাষায়, প্রেম এক ধরনের ফারমেন্টেশন — যার জন্য সময় লাগে, অপেক্ষা করতে হয়, এবং আন্তরিকতা নিয়ে বিশ্বাস রাখতে হয়।

গড় নয়বিশদে বোঝার গল্প

২০১১ সালের মহাবিপর্যয়ের পর তোহোকুতে এখনো বহু মানুষ গৃহহীন। তাঁদের দীর্ঘদিনের ভালোবাসা, যেমন মিসো বানানোর ধৈর্যের মতো, তাঁর কাছে অধ্যবসায়ের প্রতীক।

ফুকুশিমার গল্প পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়, বরং ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া এক বাটির ভাত আর তার ওপর যত্নে দেওয়া তরকারির মাধ্যমেই তা বোঝানো যায়।

বিজ্ঞান, খাদ্য আর সমাজ — সব একই বার্তা দেয়: গড় মানে সব নয়। বুঝতে হলে আমাদের একক অনু, এক চামচ চাটনি, বা একজন নাগরিককে আলাদাভাবে দেখতে হবে। শ্রেণিবিন্যাস বন্ধ করে, বাস্তবতা ও গভীরতায় উপলব্ধি করলেই আমরা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারি জগৎকে।

৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া

খাদ্য, বিজ্ঞান ও সমাজ: একেকটি স্বাদের গভীর বার্তা

১১:০০:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

জাপানে ভারতীয় খাবারের ভিন্নতা

২০১৪ সালে প্রথম জাপান সফরের সময় ত্রিশিত ব্যানার্জি যতটা না বিস্মিত হয়েছিলেন কাঁচা মাছ আর ভিনেগারযুক্ত চাল খেয়ে, তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলেন বিশাল সাইজের নান দেখে। সেই রুটি, উজ্জ্বল লাল রঙের মাখন-মুরগির তরকারির সঙ্গে, তাঁর কাছে ভারতীয় খাবারের অদ্ভুত এক সংস্করণ মনে হয়েছিল।

২০১৫ সালে তিনি জাপানে এসে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে পড়েন। এখানে ভারতীয় খাবারের প্রচলিত রূপ তাঁর কাছে একেবারেই অপরিচিত ছিল। অথচ বাড়িতে মা প্রতিদিনের খাবার সাজাতেন তিন ধাপে — প্রথমে ঘি ও লবণ দিয়ে ভাত বা ভাজা সবজির খোসা, এরপর মাছের মাথা দিয়ে ডাল ও ভাজি, এবং সবশেষে রুই/কাতলা মাছের তরকারি, টক-মিষ্টি টমেটোর চাটনি ও মিষ্টি।

এই বিশ্লেষণধর্মী খাবার প্রস্তুতির পেছনে মায়ের মনোযোগ ছিল বিজ্ঞানভাবনার ভিত্তি। এর থেকেই তাঁর গবেষণার পথ তৈরি হয়।

গবেষণায় একক অনু ও আত্মোপলব্ধি

স্নাতক শেষ করে ব্যানার্জি ডিএনএ-যুক্ত প্রোটিন নিয়ে পিএইচডি গবেষণায় যোগ দেন। গবেষণায় দুটি পদ্ধতি রয়েছে — একটি হলো ‘এনসেম্বল’ পদ্ধতি, যেখানে অনেক অনুর গড় তথ্য নেওয়া হয়, আর অন্যটি ‘সিঙ্গল-মলিকিউল’ পদ্ধতি, যেখানে প্রতিটি অনুকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাঁর গবেষণাগার দ্বিতীয় পদ্ধতিকে অনুসরণ করে।

প্রথম বছরটা তাঁর কেটেছে অন্ধকার ঘরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একক অনু পর্যবেক্ষণ করে, কোনো ফলাফল ছাড়াই। তবে একবার সফল হলে যে আনন্দ, তার তুলনা নেই।

সমাজের সঙ্গে সংযোগ: ফুকুশিমার পথে

ক্যাম্পাসের বাইরের জগতে যুক্ত হওয়ার তাগিদ থেকেই তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালে সেনদাইয়ে আসার পর তিনি তোহোকু অঞ্চলের পর্যটন পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় যুক্ত হন। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় ফুকুশিমার ফুতাবা শহরে কাজ করা ইয়ামানে তাতসুহিরোর সঙ্গে। পরে তিনি ফুতাবা এরিয়া ট্যুরিজম রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনে (F-ATRAs) যোগ দেন এবং শহরের ইতিহাস, সংস্কৃতি নিয়ে হাঁটার ট্যুর আয়োজন করেন।

২০২৩ সালে জাপান যখন প্রক্রিয়াজাত পানি প্রশান্ত মহাসাগরে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন বৈজ্ঞানিক তথ্য নিয়ে যত না আপত্তি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল বিশ্বাসের সংকট। এখনো ফুকুশিমা অনেকের কাছে আতঙ্কের নাম।

তাই স্থানীয়দের নিয়ে ইতিবাচক গল্প তৈরি এবং বিশ্বাস পুনর্গঠনই তাঁর কাজের মূল লক্ষ্য।

রান্নাঘরে সমাজের ভাষা

২০২৪ সালের বসন্তে ব্যানার্জি একটি প্রাতিষ্ঠানিক নৈশভোজ আয়োজন করেন, যেখানে তিনি ভারতীয় খাবারকে মাল্টিকোর্স আকারে পরিবেশন করেন। একটি ডিশ ছিল ‘শাহী কোরমা’, যা তাজমহলের উদ্বোধনে পরিবেশিত হতো এমন একটি সাদা কারি। তবে তিনি জানতেন, জাপানিদের অনেকেই ধনেপাতার স্বাদ অপছন্দ করেন। তাই তিনি এর পরিবর্তে ব্যবহার করেন স্থানীয় ‘হাবানোরি’ সামুদ্রিক শৈবাল, যা খাবারে গভীরতা আনে এবং বাদাম-দইয়ের কোরমার সঙ্গে মিশে যায়। এটা একই বার্তা — ভিন্ন ভাষায় বলা।

জাতিও একধরনের এনসেম্বল

একক অনু পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে, বড় কাঠামোকে বোঝার জন্য ছোট উপাদান বুঝতে হয়। যেমন, গণতন্ত্রও অনেক সময় কেবল গড় মতামত প্রকাশ করে। কিন্তু ‘জাতি’ গঠনের পেছনে থাকে হাজারো ছোট ছোট গল্প, স্থানিক ইতিহাস, সংস্কৃতি। এই ভাবনাই তাঁকে নিজের আশপাশের মানুষ, ছোট শহর, রান্না — সবকিছুকে ভিন্নভাবে দেখতে শেখায়।

বিজ্ঞানখাদ্য ও প্রেম: ধৈর্যের উপাখ্যান

২০২৪ সালের শরতে তিনি সেনদাই থেকে নামিয়ে শহরে চলে যান। সেখানে তিনি নতুন বছরের জন্য ‘ওসেচি রিয়োরি’ (নববর্ষের খাবার) বানান। এর মধ্যে ছিল সেনদাইয়ের কুয়াই (কচুরমূলো) এবং নামিয়ে শহরের হিজুনামাসু (স্যালমনের মাথার তরল অংশ ও মূলা) — যা তাঁর জাপানি জীবনের দুটি স্তম্ভকে একত্র করে।

এছাড়া তিনি শৈশবের টমেটো চাটনিও নতুনভাবে তৈরি করেন, যেখানে লেবুর রসের বদলে ব্যবহার করেন ‘ইউজু’ খোসা। এই বসন্তে তিনি নিজেই তৈরি করেন কোজি — জাপানের বিখ্যাত ছাঁচ যা সাকে ও মিসো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

তাঁর ভাষায়, প্রেম এক ধরনের ফারমেন্টেশন — যার জন্য সময় লাগে, অপেক্ষা করতে হয়, এবং আন্তরিকতা নিয়ে বিশ্বাস রাখতে হয়।

গড় নয়বিশদে বোঝার গল্প

২০১১ সালের মহাবিপর্যয়ের পর তোহোকুতে এখনো বহু মানুষ গৃহহীন। তাঁদের দীর্ঘদিনের ভালোবাসা, যেমন মিসো বানানোর ধৈর্যের মতো, তাঁর কাছে অধ্যবসায়ের প্রতীক।

ফুকুশিমার গল্প পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়, বরং ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া এক বাটির ভাত আর তার ওপর যত্নে দেওয়া তরকারির মাধ্যমেই তা বোঝানো যায়।

বিজ্ঞান, খাদ্য আর সমাজ — সব একই বার্তা দেয়: গড় মানে সব নয়। বুঝতে হলে আমাদের একক অনু, এক চামচ চাটনি, বা একজন নাগরিককে আলাদাভাবে দেখতে হবে। শ্রেণিবিন্যাস বন্ধ করে, বাস্তবতা ও গভীরতায় উপলব্ধি করলেই আমরা প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারি জগৎকে।