সাবেক সিইসি’র ওপর সন্ত্রাসীদের হামলা
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার ওপর “মব ভায়োলেন্স” বা সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন দেশের ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনানুগ কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি, হুদার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যথাযথ তদন্ত ও সুবিচারের দাবিও জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা দেশে বেড়ে চলা মব সহিংসতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।
ঘটনার বিবরণ: বাড়ি থেকে বের করে এনে অপমান
২২ জুন ২০২৫, রোববার, রাজধানীর উত্তরায় কে এম নুরুল হুদার বাসায় ঢুকে একদল লোক তাঁকে জোরপূর্বক বের করে আনে এবং জুতার মালা গলায় পরিয়ে অপমান করে। এর আগে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। পরে পুলিশ তাঁকে হেফাজতে নেয় এবং দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পুলিশ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সহিংসতা
ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা হামলাকারীদের প্রতিরোধ করেনি, বরং তাদের ঔদাসীন্যের কারণে সহিংসতা নির্বিঘ্নে ঘটে যায়। এই নিষ্ক্রিয়তা এবং সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নমনীয় মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিবৃতিদাতারা।
ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার নিশ্চিতে জোর দাবি
নাগরিকদের মতে, কে এম নুরুল হুদার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত। কোনো অপরাধীরও বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত মৌলিক মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অধিকার কারোরই নেই। মব সহিংসতার মাধ্যমে বিচার করে ফেলার সংস্কৃতি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা এবং এটি নাগরিক অধিকার ও জননিরাপত্তার মারাত্মক লঙ্ঘন।
মব সহিংসতা বাড়ছে, কিন্তু শাস্তি নেই
বিবৃতিদাতারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গত আট-দশ মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সেসবের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে এবং ঘটনা বাড়ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে হতাশা
বেশিরভাগ মব সহিংসতায় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের সম্পৃক্ততা দেখা গেলেও, দায়িত্বশীল দলগুলো এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়নি বলে বিবৃতিতে দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের অঙ্গীকার ছিল—আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকারের সুরক্ষা। অথচ বাস্তবে তার বিপরীত ঘটছে।
নাগরিকদের তিন দফা দাবি
নাগরিকরা তিনটি সুস্পষ্ট দাবি উত্থাপন করেছেন:
দোষীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তি:
ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে যারা সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে লাঞ্ছিত করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া:
সাবেক সিইসি বা অন্য কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা আইনসম্মতভাবে তদন্ত ও বিচার করতে হবে। মানবিক মর্যাদাবিরোধী আচরণ যেন আর না ঘটে, সেজন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সমাজের সব স্তরের মানুষকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
মব সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক উদ্যোগ:
দেশব্যাপী সচেতনতামূলক প্রচার, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ও পরামর্শসেবা চালু করতে হবে, যাতে সমাজে এই প্রবণতা কমে এবং একটি মানবিক মূল্যবোধভিত্তিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
বিবৃতিতে যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন
এই বিবৃতিতে যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, খুশী কবির, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, রাশেদা কে চৌধুরী, শামসুল হুদা, শাহীন আনাম, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, আইনজীবী জেড আই খান পান্না, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, গবেষক রেহনুমা আহমেদ, লেখক দীপায়ন খীসা, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, আইনজীবী, উন্নয়নকর্মী ও মানবাধিকার সংস্থার নেতৃবৃন্দ।
স্পষ্ট বার্তা সরকারের প্রতি
এই বিবৃতির মাধ্যমে তাঁরা স্পষ্টভাবে সরকারের কাছে বার্তা দিয়েছেন যে, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে মব সহিংসতার প্রতিটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে তা জনসচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা—দুইটির জন্যই ভয়াবহ হুমকিতে পরিণত হবে।