০৯:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া উনসানে সমুদ্র সৈকতের রিসোর্ট উদ্বোধন: পর্যটনে বাজি ধরছে উত্তর কোরিয়া ওএমএস ও টিসিবি ডিলার নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান এসএসসি টেস্টের দুই দিনে শ্রীলঙ্কার রাজত্ব রাসেল ভাইপারের হুমকি: শহরেও ঢুকছে বিপজ্জনক সাপ! মঙ্গল অভিযানের প্রস্তুতি: মহাকাশে পাঠানো হলো গাঁজা গাছের বীজ ২০২৫ সালের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ আইসল্যান্ড, শীর্ষ দশে সিঙ্গাপুর নৌকার বাংলাদেশ: জেলা-জেলা ঘিরে এক ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বা পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কী? কীভাবে এটি করা হয়? নেতানিয়াহুর বিচার বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের

রোমান রক্তপাত থেকে বাংলাদেশের মব ভায়োলেন্সের অন্ধ গতি

সভ্যতার দীর্ঘ পথচলায় উত্তেজিত জনতা বারবার আইন, নীতি ও সভ্যতার বেড়াজাল ভেঙে রক্তপাতকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। আজও বাংলাদেশের রাজপথে—কখনও ধানমণ্ডি ৩২-এর ঐতিহাসিক বাড়ি গুঁড়িয়ে, কখনও একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অপমান করে—প্রচলিত বিচারব্যবস্থা নয়, ‘জনতার বিচার’ই যেন শেষ কথা। এ প্রতিবেদন খতিয়ে দেখছে প্রাচীন সময়ের সামূহিক সহিংসতা থেকে শুরু করে গত ১১ মাসের বাংলাদেশ, যেখানে রাজনৈতিক শূন্যতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি মব ভায়োলেন্সকে আরও সাহসী করে তুলছে।

ইতিহাসের লাল দাগ

সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড (খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯) থেকে জুলিয়াস সিজারের হত্যাকাণ্ড (খ্রিস্টপূর্ব ৪৪)—দুটিই আদালত ও সেনেটের রায়ের মোড়কে আসলে জনতার চাপের ফসল। ইউরোপের ‘ডাইনি শিকার’ যুগে (১৬–১৭ শতক) হাজারো নারীর দাহযজ্ঞ সংঘটিত হয় গুজব আর ধর্মীয় উন্মাদনায়। অনিয়ন্ত্রিত ভিড়ের হাতে ন্যায়বিচার যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে, সেই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশ: মবের অভয়ারণ্য

আগস্ট ২০২৪–জুন ২০২৫ সময়ে দেশে অন্তত ৮৩টি মৃত্যু ও শতাধিক হামলার তথ্য দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা শূন্যতায় মব ভায়োলেন্স আজ ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধ্বংসস্তূপে ইতিহাস: ধানমণ্ডি ৩২-এর ট্র্যাজেডি

৫–৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: রাত গড়াতেই ‘বুলডোজার মার্চ’-এর ডাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমন্বয় করা শত শত বিক্ষোভকারী প্রথমে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল জাদুঘরের ফটক ভাঙে, পরে সরকারি সংস্থার লোগোসংবলিত বুলডোজার ও একাধিক এক্সকাভেটর ঢুকিয়ে মূল ভবন গুঁড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, সোনালি রঙের প্রথম বুলডোজারটি ১২:১০-এ এসে যোগ দেয়; নীল বুলডোজারটি ভোরে পৌঁছায়। প্রায় সব ধ্বংসকাজ শেষ হয় সকাল নাগাদ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে থাকলেও কার্যত হস্তক্ষেপ করেনি। ফলে শুধু একটি বাড়ি নয়—মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় ঐতিহ্য আর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত স্মৃতির ধারক একটি সম্পদই মুছে গেল ইতিহাস থেকে।

সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদার হেনস্তা

২২ জুন ২০২৫, ঢাকা (উত্তরা): সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে তার বাসা থেকে টেনে বের করে জুতার মালা পরানো হয়; মুখে জুতা মেরে ও বেধড়ক মারধর করে মব সন্ত্রাসীরা। পুরো ঘটনা লাইভ-স্ট্রিম হয়। অথচ রাষ্ট্র ছিল অনেকটা নির্লিপ্ত। পরে ছয়জনের নামে মামলা হলেও জনমনে আস্থার ঘাটতি পূরণ হয়নি।

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক হামলা

২৯ নভেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রাম: একসঙ্গে তিনটি হিন্দু মন্দিরে চড়াও হয়ে প্রতিমা ও প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দির-পূজামণ্ডপে হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা-ধর্ষণের ঘটনায় ভয়াবহ বৃদ্ধি দেখা যায়।

পাবনায় মানসিক রোগীকে পিটিয়ে হত্যা

নভেম্বর ২০২৪-এ পাবনা সদরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে চুরির গুজবে আটকিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়; শরীরে ছিল নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। এ ঘটনা দেখায়, অপরাধী শনাক্ত না করেই জনতা কীভাবে নিষ্ঠুর বিচারক হয়ে উঠতে পারে।

মূল কারণ: কেন বারবার ফিরে আসে মব ভায়োলেন্স

  • বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভুয়া সংবাদ ও গুজব
  • রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় সশস্ত্র ছাত্র-যুব সংগঠনের দৌরাত্ম্য
  • নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যার দায়মুক্তি সংস্কৃতি
  • সাম্প্রদায়িক উসকানি ও সংখ্যালঘু ভীতি

সম্ভাব্য করণীয়

  • ‘গুজব মনিটরিং সেল’—২৪/৭ অনলাইন নজরদারি এবং রিয়েল-টাইম ফ্যাক্ট-চেক
  • মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই সহনশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাগরিক অধিকারভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক
  • সংখ্যালঘু ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশাজীবীদের জন্য হটলাইন, নিরাপত্তা সেল ও ক্ষতিপূরণ তহবিল
  • ঐতিহাসিক স্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষায় বিশেষ আইন; জরুরি প্রয়োজনে সেনা মোতায়েনের বিধান

বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, নুরুল হুদার অপমান, সংখ্যালঘুদের জ্বলন্ত ঘর—সব কিছুর একটাই বার্তা: সন্ত্রাসের নামে জনতা যখন বিচারক হয়, তখনই ইতিহাস বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়। গণতন্ত্রের মূল সার্থকতা আইনের শাসন; তা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশ ‘মব-নিয়ন্ত্রিত’ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই এগোচ্ছে।

৫৪০ কোটি টাকার ‘মাদক অর্থ’ পাচারে অভিযুক্ত বিক্রম সিং মজিঠিয়া

রোমান রক্তপাত থেকে বাংলাদেশের মব ভায়োলেন্সের অন্ধ গতি

০৫:০০:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

সভ্যতার দীর্ঘ পথচলায় উত্তেজিত জনতা বারবার আইন, নীতি ও সভ্যতার বেড়াজাল ভেঙে রক্তপাতকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। আজও বাংলাদেশের রাজপথে—কখনও ধানমণ্ডি ৩২-এর ঐতিহাসিক বাড়ি গুঁড়িয়ে, কখনও একজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অপমান করে—প্রচলিত বিচারব্যবস্থা নয়, ‘জনতার বিচার’ই যেন শেষ কথা। এ প্রতিবেদন খতিয়ে দেখছে প্রাচীন সময়ের সামূহিক সহিংসতা থেকে শুরু করে গত ১১ মাসের বাংলাদেশ, যেখানে রাজনৈতিক শূন্যতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি মব ভায়োলেন্সকে আরও সাহসী করে তুলছে।

ইতিহাসের লাল দাগ

সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড (খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯) থেকে জুলিয়াস সিজারের হত্যাকাণ্ড (খ্রিস্টপূর্ব ৪৪)—দুটিই আদালত ও সেনেটের রায়ের মোড়কে আসলে জনতার চাপের ফসল। ইউরোপের ‘ডাইনি শিকার’ যুগে (১৬–১৭ শতক) হাজারো নারীর দাহযজ্ঞ সংঘটিত হয় গুজব আর ধর্মীয় উন্মাদনায়। অনিয়ন্ত্রিত ভিড়ের হাতে ন্যায়বিচার যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে, সেই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশ: মবের অভয়ারণ্য

আগস্ট ২০২৪–জুন ২০২৫ সময়ে দেশে অন্তত ৮৩টি মৃত্যু ও শতাধিক হামলার তথ্য দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা শূন্যতায় মব ভায়োলেন্স আজ ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধ্বংসস্তূপে ইতিহাস: ধানমণ্ডি ৩২-এর ট্র্যাজেডি

৫–৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: রাত গড়াতেই ‘বুলডোজার মার্চ’-এর ডাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমন্বয় করা শত শত বিক্ষোভকারী প্রথমে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল জাদুঘরের ফটক ভাঙে, পরে সরকারি সংস্থার লোগোসংবলিত বুলডোজার ও একাধিক এক্সকাভেটর ঢুকিয়ে মূল ভবন গুঁড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, সোনালি রঙের প্রথম বুলডোজারটি ১২:১০-এ এসে যোগ দেয়; নীল বুলডোজারটি ভোরে পৌঁছায়। প্রায় সব ধ্বংসকাজ শেষ হয় সকাল নাগাদ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে থাকলেও কার্যত হস্তক্ষেপ করেনি। ফলে শুধু একটি বাড়ি নয়—মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় ঐতিহ্য আর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত স্মৃতির ধারক একটি সম্পদই মুছে গেল ইতিহাস থেকে।

সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদার হেনস্তা

২২ জুন ২০২৫, ঢাকা (উত্তরা): সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে তার বাসা থেকে টেনে বের করে জুতার মালা পরানো হয়; মুখে জুতা মেরে ও বেধড়ক মারধর করে মব সন্ত্রাসীরা। পুরো ঘটনা লাইভ-স্ট্রিম হয়। অথচ রাষ্ট্র ছিল অনেকটা নির্লিপ্ত। পরে ছয়জনের নামে মামলা হলেও জনমনে আস্থার ঘাটতি পূরণ হয়নি।

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক হামলা

২৯ নভেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রাম: একসঙ্গে তিনটি হিন্দু মন্দিরে চড়াও হয়ে প্রতিমা ও প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দির-পূজামণ্ডপে হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা-ধর্ষণের ঘটনায় ভয়াবহ বৃদ্ধি দেখা যায়।

পাবনায় মানসিক রোগীকে পিটিয়ে হত্যা

নভেম্বর ২০২৪-এ পাবনা সদরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে চুরির গুজবে আটকিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়; শরীরে ছিল নৃশংস নির্যাতনের চিহ্ন। এ ঘটনা দেখায়, অপরাধী শনাক্ত না করেই জনতা কীভাবে নিষ্ঠুর বিচারক হয়ে উঠতে পারে।

মূল কারণ: কেন বারবার ফিরে আসে মব ভায়োলেন্স

  • বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভুয়া সংবাদ ও গুজব
  • রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় সশস্ত্র ছাত্র-যুব সংগঠনের দৌরাত্ম্য
  • নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যার দায়মুক্তি সংস্কৃতি
  • সাম্প্রদায়িক উসকানি ও সংখ্যালঘু ভীতি

সম্ভাব্য করণীয়

  • ‘গুজব মনিটরিং সেল’—২৪/৭ অনলাইন নজরদারি এবং রিয়েল-টাইম ফ্যাক্ট-চেক
  • মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই সহনশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাগরিক অধিকারভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক
  • সংখ্যালঘু ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশাজীবীদের জন্য হটলাইন, নিরাপত্তা সেল ও ক্ষতিপূরণ তহবিল
  • ঐতিহাসিক স্থাপনা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুরক্ষায় বিশেষ আইন; জরুরি প্রয়োজনে সেনা মোতায়েনের বিধান

বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, নুরুল হুদার অপমান, সংখ্যালঘুদের জ্বলন্ত ঘর—সব কিছুর একটাই বার্তা: সন্ত্রাসের নামে জনতা যখন বিচারক হয়, তখনই ইতিহাস বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়। গণতন্ত্রের মূল সার্থকতা আইনের শাসন; তা নিশ্চিত না হলে বাংলাদেশ ‘মব-নিয়ন্ত্রিত’ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই এগোচ্ছে।