নজরুল: পরিশিষ্ট
কবির সামনে বসিয়া আমি এরূপ ভাবিতেছি ইতিমধ্যে রান্না শেষ হইয়াছে। অর্ধাঙ্গ হইয়া ভাবি এখন উঠিতে পারেন না। তাঁহার বিছানার পাশেই আমার খাওয়ার জায়গা হইল। চৌকির উপর হইতে নীচে ঝুঁকিয়া ভাবি আমার পাতে খাদ্য-সামগ্রী তুলিয়া দিতে দিতে কতই স্নেহে বলিতেছিলেন, “এটা খাও ভাই, এটা খাও ভাই।” সেই স্নেহের ডাক আর কোনোদিন শুনিব না।
দেশে ফিরিয়া আসিলাম। সেবার শুনিলাম আমার এত মমতার ভাবি চিরজনমের মতো চলিয়া গিয়াছেন। ছোট ছেলের নাকি ইচ্ছা ছিল তার মাকে হিন্দু প্রথামতো চিতায় তুলিয়া পোড়ানো হউক, কিন্তু বড় ছেলে বলিল, “মৃত্যুর আগে মা বলে গেছেন, আমাকে যেন কবির বাসস্থানে লইয়া গিয়া কবর দেয়া হয়।” কবির অনুরাগী শত শত বন্ধু ইহাই সমর্থন করিলেন। সেই অনুসারে ভাবিকে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়া লইয়া গিয়া কবরস্থ করা হয়। সেখানে তো ভাবির কেহই নাই। তাঁর জন্য কবরে বসিয়া কে এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন করিবে।
নজরুলের ভ্রাতৃবধুরা কেহই তো ভাবিকে আমাদের মতো চক্ষে দেখিবেন না। যে চলিয়া গিয়াছে, তার দেহ যে কোনো জায়গায়ই থাকুক তাতে কি আসে যায়। একদিন কোনো অনাগত কালে হয়তো কবির মৃতদেহটি ভাবির কবরের পাশে চিরকালের মতো শায়িত হইবে। পাশা-পাশি কবর হইলেই মানুষ একত্রিত হইতে পারে না। তবু এই ক্ষীণ আশাটি বক্ষে লইয়া হিন্দু সমাজের এই মেয়েটি হয়তো অনভ্যস্ত মুসলমানি প্রথায় নিজেকে কবরস্থ করিবার জন্য অনুরোধ করিয়া গিয়াছিলেন। ভাবি যে কবিকে কত ভালো বাসিতেন ইহা তাহার একটি
জ্বলন্ত প্রমাণ। সেবার নজরুল জন্মতিথিতে নিমন্ত্রিত হইয়া কলিকাতা গেলাম। মিঃ আলভি তখন কলিকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার। নজরুলের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে এক তোড়া
ফুলের মালা লইয়া কবিকে দেখিতে গেলাম। ফুলের মালা পরিয়া কবি যেন বেশ খুশি হইলেন। অল্পক্ষণেই বুঝিতে পারিলাম কবির বড় ছেলের বউ কবিকে আন্তরিকভাবেই সেবা যত্ন করিতেছেন। কবির শয্যাপার্শ্বে আজ আমার সেই সদাহাস্যময়ী, মমতাময়ী, ভাবিকে আর দেখিতে পাইলাম না। মনে হইল অন্তরিক্ষ হইতেই, যাঁরা আজ কবিকে সেবাযত্ন করিতেছেন তাঁহাদের প্রতি তিনি আশীর্বাদ বর্ষণ করিতেছেন।
যৌবনকাল হইতেই কবিকে দেখিতেছি। ধীরে ধীরে যেন কবির সেই শ্যামল স্বাস্থ্য-ভরা দেহে বার্ধক্য আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিতেছে। সেই বড় বড় ডাগর চোখ দুটি আজও কবি মেলিয়া ধরেন। কিন্তু সেই চোখ দুটি দিয়া দেখিয়া তিনি আর আমাদিগকে চিনিতে পারেন না।
চলবে…..