শতবর্ষের নদীর এক নীরব সাক্ষ্য
খুলনার দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া শিবসা নদী শুধু একটি জলপ্রবাহ নয়, বরং এটি সুন্দরবন ও খুলনা উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, ইতিহাস ও জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় শতবর্ষ ধরে নদীটি ছিল বন-জঙ্গল ঘেরা নির্জন অঞ্চল থেকে জনবসতিপূর্ণ স্থানে রূপান্তরের সাক্ষী। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ দখল ও দূষণের কারণে আজ শিবসা নদীর সেই প্রাণবন্ততা অনেকটাই বিপন্ন।
নদীর উৎস ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
শিবসা নদীর উৎপত্তি কপোতাক্ষ নদের একটি শাখা থেকে, যা পাইকগাছা ও দাকোপ হয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রে এই নদীর উল্লেখ রয়েছে এবং সেই সময় নদীটি খুলনার উপকূলীয় গ্রামগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য, মাছ ধরার অর্থনীতি এবং সুন্দরবনের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শিবসার পাড়েই গড়ে উঠেছে বহু পুরনো বাজার, ঘাট, লঞ্চ টার্মিনাল ও বন বিভাগের অফিস।
সুন্দরবনের সঙ্গে গভীর সংযোগ
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের বিশাল একটি অংশ শিবসা নদীর জলপ্রবাহে জীবন্ত থাকে। এই নদীর লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নদী দিয়ে সাগর থেকে প্লাঙ্কটন, পুষ্টিকর জৈবপদার্থের আসা – সব কিছুই বনটির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। এই নদীর তীরে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বনমোরগের মতো প্রাণীদের দেখা মেলে। নদীর স্রোত ও জোয়ার-ভাটা সুন্দরবনের গাছপালা এবং জমিনের আর্দ্রতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে।
জলজ প্রাণী: কুমির, ডলফিন ও হাঙরের আবাসস্থল
শিবসা নদী এক সময় ছিল ভয়ংকর মিঠা পানির কুমিরের আবাসস্থল। এখনো মাঝে মাঝে বাঘাইর কুমির দেখা যায়। এছাড়া এই নদীতে রয়েছে বিরল ইরাবতী ডলফিন, যাদের ডাকা হয় ‘নদীর সুস্থতার বার্তাবাহক’ নামে। ডলফিনেরা নদীর প্রবাহ ও জলমান ভালো থাকলেই টিকে থাকে। নদীতে এক সময় গাঙ্গেয় প্রজাতির ছোট হাঙর পাওয়া যেত, যদিও এখন এদের দেখা মেলে না বললেই চলে।
মৎস্যজীবী সমাজ ও মাছের বৈচিত্র্য
দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রার অসংখ্য মানুষ শিবসা নদী থেকে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে শতবর্ষ ধরে। এই নদীতে পাঙ্গাশ, বাগদা চিংড়ি, হরিনা, কোরাল, বাটা, গলদা, বোয়ালসহ নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। তবে গত এক দশকে লবণাক্ততার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, শিল্পবর্জ্য ও অতিরিক্ত ট্রলিংয়ের কারণে মাছের ঘনত্ব কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে।
মানববসতি ও জলদস্যুদের দিনকাল
এক সময় শিবসার দক্ষিণ দিকে বন ছিল ঘন, জনমানব ছিল না বললেই চলে। নদীর ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে নতুন নতুন জনবসতি। তবে আশির দশকে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্যে নদী এলাকা আতঙ্কের স্থানে পরিণত হয়েছিল। পরে কোস্টগার্ড ও বন বিভাগের টহল বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়। এখন নদীসংলগ্ন গ্রামে স্কুল, হাটবাজার, মৎস্যঘাট গড়ে উঠেছে।
বর্তমান অবস্থা: দূষণ, সংকোচন ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
দুঃখজনক হলেও সত্য, শিবসা নদী বর্তমানে দূষণ, ড্রেজিংয়ের অভাব, অপরিকল্পিত বাঁধ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলায় মৃতপ্রায় হয়ে উঠেছে। নদীর গতিপথ সংকুচিত হয়েছে; চর পড়ে গেছে মাঝ নদীতে। প্লাস্টিক ও বিষাক্ত বর্জ্য এসে পড়ছে জলজ প্রাণীর খাদ্যচক্রে। পানির রঙ বদলে গেছে, মৎস্য উৎপাদন কমেছে।
সুন্দরবনের ওপর প্রভাব
নদীর প্রাণহীনতা সরাসরি সুন্দরবনের ওপর প্রভাব ফেলছে। শিবসা নদীর স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা ও পুষ্টিদ্রব্য প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের মাটি হয়ে উঠছে লবণাক্ত, গাছের বৃদ্ধি থেমে যাচ্ছে। বন্যপ্রাণীদের পানির অভাব দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মকালে অনেক খাল শুকিয়ে যায়, ফলে পশুপাখিরা দূরে চলে যাচ্ছে বা মরছে।
বাঁচাতে হবে শিবসাকে, বাঁচাতে হবে সুন্দরবনকে
শিবসা নদী শুধুই একটি জলপথ নয়, এটি সুন্দরবনের প্রাণরসায়ন ও খুলনার পরিবেশ-অর্থনীতির এক কেন্দ্রবিন্দু। এই নদী বাঁচলে বাঁচবে জীববৈচিত্র্য, বাঁচবে মৎস্যজীবী পরিবার, এবং টিকে থাকবে সুন্দরবন। শিবসা নদীর পুনর্জীবনের জন্য চাই জরুরি ড্রেজিং, শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণ, জলপ্রবাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং স্থানীয়দের অংশগ্রহণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
শিবসা—তাকে বাঁচানো মানে শুধু নদী নয়, একটি ঐতিহ্য, একটি বন, একটি জীবনকে বাঁচানো।