বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে যদি একজন নাম লেখা হয় যিনি পুরো খেলাটির গতিপথ বদলে দিয়েছেন, তবে নিঃসন্দেহে সেটি সাকিব আল হাসান। তার ব্যাটিং-বোলিং দক্ষতা, নেতৃত্বের সাহসিকতা, ও কৌশলী মানসিকতা শুধু দেশেই নয়—বিশ্ব ক্রিকেটেও অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই কিংবদন্তির ক্রিকেট-জীবনের কিছু মুহূর্ত শুধু স্মরণীয় নয়, বরং ইতিহাসের অংশ।
ছোট শহরের ছেলে, বড় স্বপ্ন
১৯৮৭ সালের ২৪ মার্চ মাগুরায় জন্ম সাকিব আল হাসানের। স্থানীয় পর্যায়ে ক্রিকেট খেলে শুরু হয় তার যাত্রা। পরে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে পেশাদার প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে একজন নিখুঁত অলরাউন্ডারের ভিত্তি। ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার পথচলা শুরু।
অলরাউন্ডার হিসেবে বিশ্বসেরার মুকুট
সাকিব তিন ফরম্যাটেই আইসিসি র্যাংকিংয়ের এক নম্বর অলরাউন্ডার হয়েছেন—বিশ্বক্রিকেটে এমন নজির হাতে গোনা।
- ওয়ানডে: ৭,৪০০+ রান, ৩০৫ উইকেট
- টেস্ট: ৪,৫০০+ রান, ২৩৮ উইকেট
- টি-টোয়েন্টি: ২,৩০০+ রান, ১৪০+ উইকেট
এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, সাকিব কেবল পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার নন, বরং যেকোনো ম্যাচে এককভাবে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো খেলোয়াড়।
স্মরণীয় কিছু ম্যাচ ও পারফরম্যান্স
১. ২০১৯ বিশ্বকাপ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (৩৮১ রান তাড়া)
সাকিব খেলেন ১২৪ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস, যেখানে ছিল বিশ্বমানের টাইমিং ও শটের প্রদর্শনী। তার ইনিংসটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা চেজ হিসেবে স্বীকৃত।
২. ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বনাম নিউজিল্যান্ড
বাংলাদেশ যখন ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে, তখন সাকিব খেলেন ১১৪ রানের অসাধারণ ইনিংস। মহম্মদ মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ২২৪ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে জেতান এবং সেমিফাইনালে তুলে দেন।
৩. ২০০৮ বনাম নিউজিল্যান্ড (চট্টগ্রাম টেস্ট)
৫ উইকেট নিয়ে কিউই ব্যাটিং লাইন ভেঙে দেন এবং একই ম্যাচে ব্যাটেও অবদান রাখেন। এই ম্যাচই ছিল তার টেস্ট ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।
৪. ২০১১ বিশ্বকাপ বনাম ইংল্যান্ড
অতিরিক্ত ডিউয়ের মধ্যে বল হাতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে ২ উইকেট নেন এবং ব্যাট হাতে ধীরস্থির ৪২ রানে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
৫. ২০২১ টি-টোয়েন্টি সিরিজ বনাম অস্ট্রেলিয়া
পাঁচ ম্যাচের সিরিজে মাত্র ৮৪ রান দিয়ে ৭ উইকেট নেন এবং ব্যাট হাতে কার্যকর ভূমিকা রাখেন। পুরো সিরিজেই সাকিব ছিলেন দলের ফুয়েল।
আন্তর্জাতিক প্রশংসা
- ব্রায়ান লারা: “সাকিব একজন ক্লাসিক অলরাউন্ডার। দলের জন্য যা দরকার, সাকিব তা দিতে পারে।”
- হার্শা ভোগলে: “বিশ্ব ক্রিকেটে এমন ব্যালান্সড অলরাউন্ডার খুবই বিরল।”
- মাইক হ্যাসন: “ওর বিপক্ষে পরিকল্পনা করা কঠিন, কারণ সে প্রতিটি বিভাগে বিপজ্জনক।”
- গৌতম গম্ভীর: “সাকিবের মতো ক্রিকেটার ভারতের একাদশে থাকলে আরও বড় অর্জন সম্ভব হতো।”
নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও সাফল্য
সাকিব নেতৃত্ব দিয়েছেন টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি দলকে। তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে (২০১৫), এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালেও উঠেছে (২০১৭)। তার কৌশলী নেতৃত্বে দলের সেরা শক্তিগুলো সামনে আসে।
বিপিএল ও বৈশ্বিক লিগে আধিপত্য
বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, রংপুর রাইডার্স ও ফরচুন বরিশালের হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে তিনটি শিরোপা জিতেছেন। আন্তর্জাতিক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ যেমন আইপিএল, সিপিএল, পিএসএলে খেলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২০১২ ও ২০১৪ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএল ট্রফি জয়ের অংশ ছিলেন তিনি।
চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাবর্তনের গল্প
২০১৯ সালে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে এক বছরের নিষেধাজ্ঞায় পড়েন। তবে ২০২০ সালে প্রত্যাবর্তনের পর আবার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। এটি তার ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগত অধ্যায়।
সামাজিক দায়িত্ব ও দৃষ্টান্ত
‘সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন’ মাধ্যমে কভিড-১৯, বন্যা, খাদ্য নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা সংকটে সাহায্য করেছেন। শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্পেও তার ভূমিকা রয়েছে।
ভবিষ্যতের সাকিব ও ক্রিকেটকে ঘিরে আশা
বয়স ৩৭ পেরিয়ে গেলেও এখনো দেশের ক্রিকেটে সাকিবের প্রভাব বিশাল। তিনি ভবিষ্যতের তরুণদের জন্য প্রেরণা এবং উদাহরণ। সাকিব নিজেই বলেছিলেন,
“বাংলাদেশ দলে এমন সময় আসবে, যখন পাঁচজন অলরাউন্ডার থাকবে। তখন বুঝব, আমি আমার ভূমিকা রেখেছি।”
তিনি শুধু একজন খেলোয়াড় নন, একটি যুগ
সাকিব আল হাসান কেবল একজন তারকা নন—একটি অধ্যায়, একটি মানদণ্ড। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খেলোয়াড়েরা সাকিবকে দেখে শিখবে কীভাবে একজন ক্রিকেটার নিজের দেশকে গর্বিত করে, কিভাবে খেলার বাইরেও মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
সাকিব আল হাসান নামটা তাই শুধু পরিসংখ্যান নয়, এক আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।