০৯:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

হোলি আর্টিজান হামলা: বাংলাদেশের হৃদয়ে রক্তাক্ত স্মৃতি ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

সারাক্ষণ রিপোর্ট

২০১৬ সালের ১ জুলাই, ঢাকার গুলশানের অভিজাত হোলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তীব্র আলোড়ন তোলে। দেশি-বিদেশি ২২ জন নিরীহ মানুষ—যার মধ্যে জাপান, ইতালি, ভারত ও আমেরিকার নাগরিক ছিলেন—নিহত হন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-সংশ্লিষ্ট পাঁচ জঙ্গির হাতে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম উচ্চমাত্রার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলা, যা সরাসরি বহির্বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

জাপানের প্রতিক্রিয়া: বন্ধুত্বের রক্তমূল্য

হামলায় নিহতদের মধ্যে সাতজন ছিলেন জাপানি নাগরিক, যারা উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতে এসেছিলেন। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (JICA)-এর মাধ্যমে তাঁরা বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। জাপানের জনগণ ও সরকার এই হামলায় শোকাভিভূত হন। টোকিওতে বাংলাদেশের দূতাবাসের সামনে শোকস্তব্ধ জনতার মোমবাতি জ্বালানো স্মরণে অনেকের চোখে জল এনে দেয়।

এই ঘটনার পরপরই জাপান বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং অনেক প্রকল্পে অংশগ্রহণ স্থগিত করে। একাধিক জাপানি কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ করে দেয়। ফলে শুধু জাপানের দিক থেকেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিষয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠেন।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ও বিনিয়োগে প্রভাব

হামলার পরপরই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ নিন্দা জানায় এবং বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ দমন প্রচেষ্টার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। তবে একই সাথে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বাস্তবায়ন ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

বিশ্বব্যাপী মিডিয়ায় “বাংলাদেশ: রাইজিং ইকোনমি বা রাইজিং থ্রেট?” শিরোনামে সংবাদ ছাপা হতে থাকে। এর ফলে অনেক বৈদেশিক বিনিয়োগপ্রস্তাব ঝুলে যায়, বিশেষ করে বন ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতে। অনেক বহুজাতিক সংস্থা বন ও পরিবেশ খাতে সম্ভাব্য ‘ফরেস্ট ইনভেস্টমেন্ট’-এ পিছিয়ে যায় নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে। বন উন্নয়ন, ইকো-ট্যুরিজম, টেকসই রাবার বা বাঁশ শিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০২৫ সালে হোলি আর্টিজান দিবস: যথাযথ শ্রদ্ধার অভাব?

২০২৫ সালে হামলার ৯ম বার্ষিকী যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন না করায় জনমনে প্রশ্ন জাগছে। যদিও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বা জাতীয় পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। এটি আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে যে বাংলাদেশ তার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বিদেশি নাগরিকদের যথাযথভাবে সম্মান জানাতে পারছে না।

বিশেষ করে জাপান, যারা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী, তারা যদি দেখে যে তাদের নাগরিকদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের জাতীয় মননে গুরুত্ব পাচ্ছে না, তাহলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উষ্ণতা কমে যেতে পারে। বিনিয়োগকারীরাও দেশটিকে ‘অসম্মানজনক’ বিবেচনায় নিতে পারেন।

জাতীয় দায়বদ্ধতা: ইতিহাসকে স্মরণ করা ভবিষ্যতের নিরাপত্তার ভিত্তি

হোলি আর্টিজান হামলা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক গভীর দুঃস্বপ্ন, কিন্তু একই সাথে এটি ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগীদের আত্মত্যাগের এক করুণ দলিল। এ হামলা কেবল নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

আমরা যদি আমাদের মাটি ও মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বিদেশি বন্ধুদের যথাযথ সম্মান না জানাই, তাহলে তা কেবল অনৈতিক নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে আত্মঘাতী।

হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জকে নগ্ন করে তুলে ধরেছিল, আবার একে ঘিরে বিশ্বসম্প্রদায়ের সহানুভূতি বাংলাদেশের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করেছিল। এই আস্থা ধরে রাখতে হলে যা করা  উচিত:

  • প্রতি বছর জাতীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন,
  • শহীদ বিদেশিদের স্মরণে স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ,
  • বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

অন্যথায়, এর ফলে  শুধু ইতিহাসকেই ভুলে যাব না, বরং ভবিষ্যত সম্ভাবনাকেও অন্ধকারে ঠেলে দেব।

হোলি আর্টিজান হামলা: বাংলাদেশের হৃদয়ে রক্তাক্ত স্মৃতি ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

০৩:৫২:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

২০১৬ সালের ১ জুলাই, ঢাকার গুলশানের অভিজাত হোলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তীব্র আলোড়ন তোলে। দেশি-বিদেশি ২২ জন নিরীহ মানুষ—যার মধ্যে জাপান, ইতালি, ভারত ও আমেরিকার নাগরিক ছিলেন—নিহত হন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-সংশ্লিষ্ট পাঁচ জঙ্গির হাতে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম উচ্চমাত্রার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলা, যা সরাসরি বহির্বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

জাপানের প্রতিক্রিয়া: বন্ধুত্বের রক্তমূল্য

হামলায় নিহতদের মধ্যে সাতজন ছিলেন জাপানি নাগরিক, যারা উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতে এসেছিলেন। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (JICA)-এর মাধ্যমে তাঁরা বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। জাপানের জনগণ ও সরকার এই হামলায় শোকাভিভূত হন। টোকিওতে বাংলাদেশের দূতাবাসের সামনে শোকস্তব্ধ জনতার মোমবাতি জ্বালানো স্মরণে অনেকের চোখে জল এনে দেয়।

এই ঘটনার পরপরই জাপান বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং অনেক প্রকল্পে অংশগ্রহণ স্থগিত করে। একাধিক জাপানি কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ করে দেয়। ফলে শুধু জাপানের দিক থেকেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিষয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠেন।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া ও বিনিয়োগে প্রভাব

হামলার পরপরই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ নিন্দা জানায় এবং বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ দমন প্রচেষ্টার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। তবে একই সাথে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বাস্তবায়ন ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

বিশ্বব্যাপী মিডিয়ায় “বাংলাদেশ: রাইজিং ইকোনমি বা রাইজিং থ্রেট?” শিরোনামে সংবাদ ছাপা হতে থাকে। এর ফলে অনেক বৈদেশিক বিনিয়োগপ্রস্তাব ঝুলে যায়, বিশেষ করে বন ও পরিবেশ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতে। অনেক বহুজাতিক সংস্থা বন ও পরিবেশ খাতে সম্ভাব্য ‘ফরেস্ট ইনভেস্টমেন্ট’-এ পিছিয়ে যায় নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে। বন উন্নয়ন, ইকো-ট্যুরিজম, টেকসই রাবার বা বাঁশ শিল্পে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০২৫ সালে হোলি আর্টিজান দিবস: যথাযথ শ্রদ্ধার অভাব?

২০২৫ সালে হামলার ৯ম বার্ষিকী যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন না করায় জনমনে প্রশ্ন জাগছে। যদিও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বা জাতীয় পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। এটি আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে যে বাংলাদেশ তার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বিদেশি নাগরিকদের যথাযথভাবে সম্মান জানাতে পারছে না।

বিশেষ করে জাপান, যারা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী, তারা যদি দেখে যে তাদের নাগরিকদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের জাতীয় মননে গুরুত্ব পাচ্ছে না, তাহলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উষ্ণতা কমে যেতে পারে। বিনিয়োগকারীরাও দেশটিকে ‘অসম্মানজনক’ বিবেচনায় নিতে পারেন।

জাতীয় দায়বদ্ধতা: ইতিহাসকে স্মরণ করা ভবিষ্যতের নিরাপত্তার ভিত্তি

হোলি আর্টিজান হামলা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক গভীর দুঃস্বপ্ন, কিন্তু একই সাথে এটি ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগীদের আত্মত্যাগের এক করুণ দলিল। এ হামলা কেবল নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

আমরা যদি আমাদের মাটি ও মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বিদেশি বন্ধুদের যথাযথ সম্মান না জানাই, তাহলে তা কেবল অনৈতিক নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে আত্মঘাতী।

হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জকে নগ্ন করে তুলে ধরেছিল, আবার একে ঘিরে বিশ্বসম্প্রদায়ের সহানুভূতি বাংলাদেশের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করেছিল। এই আস্থা ধরে রাখতে হলে যা করা  উচিত:

  • প্রতি বছর জাতীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন,
  • শহীদ বিদেশিদের স্মরণে স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ,
  • বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

অন্যথায়, এর ফলে  শুধু ইতিহাসকেই ভুলে যাব না, বরং ভবিষ্যত সম্ভাবনাকেও অন্ধকারে ঠেলে দেব।