১১:৪৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

প্রাকৃতিক মিঠা পানির মাছ  প্রেমিক এক মানুষের গল্প

মাছপ্রেমীর পরিচয় ও শৈশবের স্মৃতি

মোবারক হোসেন ৫২ বছরের এক শিক্ষক। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার হাওড়পাড়ে। ছোটবেলায় আনন্দই ছিল পুকুরনদীখালযেখানে পানির ঢেউয়ের সঙ্গে নেচে বেড়াত ট্যাংরাবোয়ালশিংকৈরুইকালবাউশ। গরমের ছুটিতে জালে ধরা টাটকা শিং মাছ বা বর্ষার সময়ে নদীর ট্যাংরা ভাজাএই স্বাদ ছিল তার শৈশবের সেরা সম্পদ। সেই দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে।

চাষের মাছের যুগে স্বাদের ক্ষয়

আজকাল বাজারে যা পাওয়া যায়তার বেশিরভাগই হ্যাচারির বা খামারের মাছ। মোবারক হোসেন বলেন, “যখনই বাজারে যাইদেখি রুইকাতলাসবই চাষের। গন্ধ নেইস্বাদ নেই। রান্নাও করলামআগের সেই স্বাদ আর মেলে না।

তিনি আরও জানানচাষের মাছের শরীরে ফিডের গন্ধ লেগে থাকে। বাজারে মাছের ঝলক থাকলেও মন ছায়াপথে খুঁজে ফেরে সেই নদীর টাটকা ঘ্রাণ।

কমছেই না মাছের দাম

প্রকৃত মাছ পেলে রূপান্তরিত অনুভূতি

এমন দিনও আসে যখন হঠাৎ বাজারে নদীর টাটকা শিংখাল থেকে ধরা কৈ বা বর্ষার রুই পেয়ে যান। তখন মোবারক হোসেন একদম বদলে যান। চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠেদাম বাড়াবেন না ভেবে খুশিতে কিনে নেন। বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে বলেন, “আজ বিশেষ রান্না হবে।

মাছ কাটাপরিষ্কার করা থেকে মসলাবাটা পর্যন্ত তিনি নিজেই করেন। রান্না শেষে বাটি হাতে বসে খেতে শুরু করলে মুখে যে তৃপ্তির হাসি ফুটেসেটা বলে বোঝানো যায় না। তিনি বলেন, “মনে হয় শৈশবে ফিরে গেছিমায়ের হাতের ঝোল খাচ্ছি।

চাষের মাছ বনাম প্রাকৃতিক মাছএকটি দার্শনিক উপলব্ধি

মোবারক হোসেনের কাছে এটা শুধু স্বাদের বিষয় নয়জীবনের পরিবর্তনের গল্পও বটে। চাষের মাছের যুগকে তিনি প্যাকেটজাত জীবনের প্রতীক’ বলেন। সব কিছুই এখন দ্রুতবানানো। মাছও তাই। আসল মাছ হারিয়ে যাচ্ছেতেমনি মানুষের আসল জীবনও কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও যোগ করেন, “নদীর মাছ শুধু খাবার নয়এটি প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের স্মারক। মাছ হারালে প্রকৃতিকেই হারাইশিকড়টাই হারাই।

অল্প জায়গায় বিপুল পরিমাণ মাছ চাষের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে \'বায়োফ্লক\'

আধুনিক প্রজন্ম ও মাছের শিক্ষা

তিনি ছেলেমেয়েদেরও মাছের স্বাদের পার্থক্য শেখান। মাছের দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখানকোনটা নদীর মাছকোনটা খামারের। তবুও তিনি আক্ষেপ করেন, “এখনকার ছেলেমেয়েরা বলে—‘সব তো মাছ!’ ওরা স্বাদের পার্থক্যকে জীবনের পার্থক্য বুঝে না।

প্রাকৃতিক মাছের জন্য সংগ্রাম

স্থানীয় বাজারের মাছওয়ালাদের ভালো করে চেনেন মোবারক হোসেনকারা নদীর মাছ আনেকারা খামারের। নদীর মাছ পেলে সবার আগে খবর পান। কখনো নিজে গ্রামে ছুটি নিয়ে যান শুধু নদীর মাছ খাওয়ার জন্য।

তিনি বলেন, “সব সময় তো পাওয়া যায় না। তাই যখনই পাইরীতিমত উৎসব করি।” তার স্ত্রী হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলেন, “ওনার শখ মেটাতে নদীর মাছের জন্য আলাদা টাকা জমাই।

প্রকৃত স্বাদপ্রকৃত মানুষ

মোবারক হোসেনের মতো মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেনপ্রকৃতি থেকেই পাওয়া যায় প্রকৃত স্বাদ। চাষের মাছের এ যুগে যেখানে শুধু পরিমাণ আর লাভের হিসাবসেখানে প্রকৃত মাছের স্বাদ জীবনের শুদ্ধতার সঙ্গে আমাদের পুনঃসংযোগ ঘটায়।

যত দিন বাঁচিনদীর মাছ খুঁজেই যাব,” বললেন তিনি, “ওটাই তো আমার শিকড়।

চাষের মাছের বাজারে প্রকৃত মাছ খোঁজা একরকম প্রতিবাদপ্রকৃতিকে ফিরে পাওয়ার ব্যক্তিগত সংগ্রাম। মোবারক হোসেনের এই গল্প আসলে সবার গল্পযদি আমরা মন খুলে শুনি।

প্রাকৃতিক মিঠা পানির মাছ  প্রেমিক এক মানুষের গল্প

০৫:০০:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

মাছপ্রেমীর পরিচয় ও শৈশবের স্মৃতি

মোবারক হোসেন ৫২ বছরের এক শিক্ষক। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার হাওড়পাড়ে। ছোটবেলায় আনন্দই ছিল পুকুরনদীখালযেখানে পানির ঢেউয়ের সঙ্গে নেচে বেড়াত ট্যাংরাবোয়ালশিংকৈরুইকালবাউশ। গরমের ছুটিতে জালে ধরা টাটকা শিং মাছ বা বর্ষার সময়ে নদীর ট্যাংরা ভাজাএই স্বাদ ছিল তার শৈশবের সেরা সম্পদ। সেই দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে।

চাষের মাছের যুগে স্বাদের ক্ষয়

আজকাল বাজারে যা পাওয়া যায়তার বেশিরভাগই হ্যাচারির বা খামারের মাছ। মোবারক হোসেন বলেন, “যখনই বাজারে যাইদেখি রুইকাতলাসবই চাষের। গন্ধ নেইস্বাদ নেই। রান্নাও করলামআগের সেই স্বাদ আর মেলে না।

তিনি আরও জানানচাষের মাছের শরীরে ফিডের গন্ধ লেগে থাকে। বাজারে মাছের ঝলক থাকলেও মন ছায়াপথে খুঁজে ফেরে সেই নদীর টাটকা ঘ্রাণ।

কমছেই না মাছের দাম

প্রকৃত মাছ পেলে রূপান্তরিত অনুভূতি

এমন দিনও আসে যখন হঠাৎ বাজারে নদীর টাটকা শিংখাল থেকে ধরা কৈ বা বর্ষার রুই পেয়ে যান। তখন মোবারক হোসেন একদম বদলে যান। চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠেদাম বাড়াবেন না ভেবে খুশিতে কিনে নেন। বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে বলেন, “আজ বিশেষ রান্না হবে।

মাছ কাটাপরিষ্কার করা থেকে মসলাবাটা পর্যন্ত তিনি নিজেই করেন। রান্না শেষে বাটি হাতে বসে খেতে শুরু করলে মুখে যে তৃপ্তির হাসি ফুটেসেটা বলে বোঝানো যায় না। তিনি বলেন, “মনে হয় শৈশবে ফিরে গেছিমায়ের হাতের ঝোল খাচ্ছি।

চাষের মাছ বনাম প্রাকৃতিক মাছএকটি দার্শনিক উপলব্ধি

মোবারক হোসেনের কাছে এটা শুধু স্বাদের বিষয় নয়জীবনের পরিবর্তনের গল্পও বটে। চাষের মাছের যুগকে তিনি প্যাকেটজাত জীবনের প্রতীক’ বলেন। সব কিছুই এখন দ্রুতবানানো। মাছও তাই। আসল মাছ হারিয়ে যাচ্ছেতেমনি মানুষের আসল জীবনও কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও যোগ করেন, “নদীর মাছ শুধু খাবার নয়এটি প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের স্মারক। মাছ হারালে প্রকৃতিকেই হারাইশিকড়টাই হারাই।

অল্প জায়গায় বিপুল পরিমাণ মাছ চাষের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে \'বায়োফ্লক\'

আধুনিক প্রজন্ম ও মাছের শিক্ষা

তিনি ছেলেমেয়েদেরও মাছের স্বাদের পার্থক্য শেখান। মাছের দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখানকোনটা নদীর মাছকোনটা খামারের। তবুও তিনি আক্ষেপ করেন, “এখনকার ছেলেমেয়েরা বলে—‘সব তো মাছ!’ ওরা স্বাদের পার্থক্যকে জীবনের পার্থক্য বুঝে না।

প্রাকৃতিক মাছের জন্য সংগ্রাম

স্থানীয় বাজারের মাছওয়ালাদের ভালো করে চেনেন মোবারক হোসেনকারা নদীর মাছ আনেকারা খামারের। নদীর মাছ পেলে সবার আগে খবর পান। কখনো নিজে গ্রামে ছুটি নিয়ে যান শুধু নদীর মাছ খাওয়ার জন্য।

তিনি বলেন, “সব সময় তো পাওয়া যায় না। তাই যখনই পাইরীতিমত উৎসব করি।” তার স্ত্রী হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলেন, “ওনার শখ মেটাতে নদীর মাছের জন্য আলাদা টাকা জমাই।

প্রকৃত স্বাদপ্রকৃত মানুষ

মোবারক হোসেনের মতো মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেনপ্রকৃতি থেকেই পাওয়া যায় প্রকৃত স্বাদ। চাষের মাছের এ যুগে যেখানে শুধু পরিমাণ আর লাভের হিসাবসেখানে প্রকৃত মাছের স্বাদ জীবনের শুদ্ধতার সঙ্গে আমাদের পুনঃসংযোগ ঘটায়।

যত দিন বাঁচিনদীর মাছ খুঁজেই যাব,” বললেন তিনি, “ওটাই তো আমার শিকড়।

চাষের মাছের বাজারে প্রকৃত মাছ খোঁজা একরকম প্রতিবাদপ্রকৃতিকে ফিরে পাওয়ার ব্যক্তিগত সংগ্রাম। মোবারক হোসেনের এই গল্প আসলে সবার গল্পযদি আমরা মন খুলে শুনি।