মাছপ্রেমীর পরিচয় ও শৈশবের স্মৃতি
মোবারক হোসেন ৫২ বছরের এক শিক্ষক। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার হাওড়পাড়ে। ছোটবেলায় আনন্দই ছিল পুকুর, নদী, খাল—যেখানে পানির ঢেউয়ের সঙ্গে নেচে বেড়াত ট্যাংরা, বোয়াল, শিং, কৈ, রুই, কালবাউশ। গরমের ছুটিতে জালে ধরা টাটকা শিং মাছ বা বর্ষার সময়ে নদীর ট্যাংরা ভাজা—এই স্বাদ ছিল তার শৈশবের সেরা সম্পদ। সেই দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে।
চাষের মাছের যুগে স্বাদের ক্ষয়
আজকাল বাজারে যা পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই হ্যাচারির বা খামারের মাছ। মোবারক হোসেন বলেন, “যখনই বাজারে যাই, দেখি রুই, কাতলা—সবই চাষের। গন্ধ নেই, স্বাদ নেই। রান্নাও করলাম, আগের সেই স্বাদ আর মেলে না।”
তিনি আরও জানান, চাষের মাছের শরীরে ফিডের গন্ধ লেগে থাকে। বাজারে মাছের ঝলক থাকলেও মন ছায়াপথে খুঁজে ফেরে সেই নদীর টাটকা ঘ্রাণ।
প্রকৃত মাছ পেলে রূপান্তরিত অনুভূতি
এমন দিনও আসে যখন হঠাৎ বাজারে নদীর টাটকা শিং, খাল থেকে ধরা কৈ বা বর্ষার রুই পেয়ে যান। তখন মোবারক হোসেন একদম বদলে যান। চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, দাম বাড়াবেন না ভেবে খুশিতে কিনে নেন। বাড়ি ফিরেই স্ত্রীকে বলেন, “আজ বিশেষ রান্না হবে।”
মাছ কাটা, পরিষ্কার করা থেকে মসলাবাটা পর্যন্ত তিনি নিজেই করেন। রান্না শেষে বাটি হাতে বসে খেতে শুরু করলে মুখে যে তৃপ্তির হাসি ফুটে, সেটা বলে বোঝানো যায় না। তিনি বলেন, “মনে হয় শৈশবে ফিরে গেছি, মায়ের হাতের ঝোল খাচ্ছি।”
চাষের মাছ বনাম প্রাকৃতিক মাছ—একটি দার্শনিক উপলব্ধি
মোবারক হোসেনের কাছে এটা শুধু স্বাদের বিষয় নয়, জীবনের পরিবর্তনের গল্পও বটে। চাষের মাছের যুগকে তিনি ‘প্যাকেটজাত জীবনের প্রতীক’ বলেন। “সব কিছুই এখন দ্রুত, বানানো। মাছও তাই। আসল মাছ হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি মানুষের আসল জীবনও কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “নদীর মাছ শুধু খাবার নয়; এটি প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের স্মারক। মাছ হারালে প্রকৃতিকেই হারাই, শিকড়টাই হারাই।”
আধুনিক প্রজন্ম ও মাছের শিক্ষা
তিনি ছেলেমেয়েদেরও মাছের স্বাদের পার্থক্য শেখান। মাছের দোকানে নিয়ে গিয়ে দেখান—কোনটা নদীর মাছ, কোনটা খামারের। তবুও তিনি আক্ষেপ করেন, “এখনকার ছেলেমেয়েরা বলে—‘সব তো মাছ!’ ওরা স্বাদের পার্থক্যকে জীবনের পার্থক্য বুঝে না।”
প্রাকৃতিক মাছের জন্য সংগ্রাম
স্থানীয় বাজারের মাছওয়ালাদের ভালো করে চেনেন মোবারক হোসেন—কারা নদীর মাছ আনে, কারা খামারের। নদীর মাছ পেলে সবার আগে খবর পান। কখনো নিজে গ্রামে ছুটি নিয়ে যান শুধু নদীর মাছ খাওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, “সব সময় তো পাওয়া যায় না। তাই যখনই পাই, রীতিমত উৎসব করি।” তার স্ত্রী হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলেন, “ওনার শখ মেটাতে নদীর মাছের জন্য আলাদা টাকা জমাই।”
প্রকৃত স্বাদ, প্রকৃত মানুষ
মোবারক হোসেনের মতো মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেন—প্রকৃতি থেকেই পাওয়া যায় প্রকৃত স্বাদ। চাষের মাছের এ যুগে যেখানে শুধু পরিমাণ আর লাভের হিসাব, সেখানে প্রকৃত মাছের স্বাদ জীবনের শুদ্ধতার সঙ্গে আমাদের পুনঃসংযোগ ঘটায়।
“যত দিন বাঁচি, নদীর মাছ খুঁজেই যাব,” বললেন তিনি, “ওটাই তো আমার শিকড়।”
চাষের মাছের বাজারে প্রকৃত মাছ খোঁজা একরকম প্রতিবাদ—প্রকৃতিকে ফিরে পাওয়ার ব্যক্তিগত সংগ্রাম। মোবারক হোসেনের এই গল্প আসলে সবার গল্প, যদি আমরা মন খুলে শুনি।