১০:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

বিনোদন জগতের অবক্ষয়: জহির রায়হান থেকে হিরো আলম পর্যন্ত যাত্রা

সারাংশ

  • • আজকের বিনোদন রুচির অবনতির পেছনে শিক্ষার মানধস গুরুত্বপূর্ণ
  • • ডিজিটাল মাধ্যমের বিস্তারে শহর-গ্রাম বিভাজন ঘুচে গেছে, রুচির মানদণ্ডও সস্তা বিনোদনের দিকে চলে গেছে
  • • বিটিভির মান নিয়ন্ত্রণের জায়গা এখন নিয়েছে ইউটিউব ও ভাইরাল-ভিত্তিক মিডিয়া, যেখানে গুণ নয়, জনপ্রিয়তাই মূল মাপকাঠি

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাটক এক সময় ছিল জাতীয় পরিচয়ের গর্ব। জহির রায়হান, আবদুল্লাহ আল মামুন, আমজাদ হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক—তাদের মতো স্রষ্টারা ছিলেন শিল্পের মানদণ্ড। কিন্তু আজকের প্রজন্মের মধ্যে “হিরো আলম” নামটি শীর্ষে চলে আসা মানে শুধু বিনোদনের রুচি বদল নয়, এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সামগ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোর পরিবর্তনের একটি প্রতিফলন।

শিল্পের স্বর্ণযুগ : জহির রায়হান থেকে সৈয়দ শামসুল হক
১৯৬০–৭০-এর দশকে বাংলাদেশের নাটক, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র ছিল সমাজ-মানস ও ইতিহাসের গভীর প্রতিফলন।

  • জহির রায়হান:“জীবন থেকে নেয়া”-র মতো রাজনৈতিক রূপক সিনেমা বানিয়েছিলেন, যা সামরিক শাসনের সমালোচনা করে জনগণের কণ্ঠকে তুলে ধরেছিল।
  • আবদুল্লাহ আল মামুন:মঞ্চনাটক এবং টেলিভিশন নাটকে সমাজের বাস্তবতা, প্রান্তিক মানুষের জীবন এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে তুলে এনেছিলেন।
  • আমজাদ হোসেন:“গোলাপী এখন ট্রেনে”-এর মতো চলচ্চিত্রে গ্রামের সমাজচিত্র, নারীর সংগ্রাম, দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন-হতাশা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
  • সৈয়দ শামসুল হক:নাটক ও চলচ্চিত্রের সংলাপকে সাহিত্যের উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, ভাষার শৈলী এবং দর্শনের গভীরতা এনেছিলেন।

তাদের কাজগুলো শুধুমাত্র বিনোদন ছিল না—এগুলো ছিল শিক্ষা, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।

শিক্ষার মানের অবনতি

বর্তমান বিনোদন রুচির পরিবর্তনের পেছনে শিক্ষা ব্যবস্থার অবক্ষয় অন্যতম কারণ।

  • সাহিত্যের পাঠ ক্রমে কমেছে। স্কুল-কলেজে নাটক বা চলচ্চিত্র-ভাষ্য বিশ্লেষণ শেখানো হয় না।
  • সাধারণ পাঠ্যক্রমে সৃজনশীল ও সমালোচনামূলক চিন্তা বিকাশে জোর নেই।
  • মানুষ সিনেমা বা নাটক দেখে শুধুই“মজা” বা “হাসি” খোঁজে, চিন্তা বা বার্তা নয়।

ফলত, দর্শকের রুচি সহজ, সস্তা বিনোদনে নামছে।

রাজনৈতিক পরিবেশ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব
এক সময় রাষ্ট্র নাটক ও চলচ্চিত্রকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখত।

  • টেলিভিশন নাটকের“স্বর্ণযুগে” বিটিভি মান নিয়ন্ত্রণ করত, ভালো লেখক-পরিচালকদের সুযোগ দিত।
  • এখন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায় বাণিজ্যিক প্রযোজক ও ইউটিউব-ভিত্তিক তারকারা,যারা নিম্নরুচির কন্টেন্ট ছড়ায়।
  • সিনেমা হল নষ্ট হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা,বিনিয়োগ সংকট ও অনিশ্চয়তার কারণে।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন

  • শহর-গ্রাম বিভাজন কমেছে,ডিজিটাল মাধ্যমের বিস্তারে সবাই সহজ বিনোদন খুঁজছে।
  • ইউটিউব,ফেসবুক—সবখানে অল্প খরচে ভিডিও বানানো যায়। দর্শক শিক্ষিত হোক বা না হোক, যে কেউ “তারকা” হতে পারে।
  • সমাজে সংলাপের ভাষা ও রুচি সাধারণ হয়েছে।“বড়লোক-গরিব” বিভাজন নেই—এখন সকলেই কমেডি বা ভাইরাল কনটেন্টে হাসে।

ফলে, সমাজের যে অংশটি আগে জহির রায়হান বা আমজাদ হোসেনকে সমর্থন করত, তারাও এখন “হিরো আলম”-এর ভিডিও দেখে মজা পায়।

সমাধান কোথায়?

  • শিক্ষায় সংস্কৃতি ও শিল্পের গুরুত্ব বাড়ানো দরকার। নাটক,সিনেমা ও সাহিত্যকে পাঠ্যক্রমে জায়গা দিতে হবে।
  • সরকারী অনুদান বণ্টনে গুণগত মানের ভিত্তিতে নির্বাচন করতে হবে।
  • টেলিভিশন ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোকে মান নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার।
  • নতুন প্রজন্মের লেখক,নির্মাতা ও অভিনেতাদের উৎসাহ দিতে হবে।

বাংলাদেশের বিনোদন জগতের মান কোনো এক দিনে পড়ে যায়নি। এটি বহু বছর ধরে শিক্ষা, রাজনীতি ও সমাজের রুচির অবক্ষয়ের ফল। জহির রায়হান, আবদুল্লাহ আল মামুন, আমজাদ হোসেন, সৈয়দ শামসুল হকের উত্তরাধিকার রক্ষা করতে হলে আমাদের এই সমস্যাগুলোর শিকড়ে হাত দিতে হবে। নাহলে “হিরো আলম” বা তার চেয়েও নিম্নমানের “তারকা” আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ন্ত্রণ করবে।

বিনোদন জগতের অবক্ষয়: জহির রায়হান থেকে হিরো আলম পর্যন্ত যাত্রা

০৫:৪২:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫

সারাংশ

  • • আজকের বিনোদন রুচির অবনতির পেছনে শিক্ষার মানধস গুরুত্বপূর্ণ
  • • ডিজিটাল মাধ্যমের বিস্তারে শহর-গ্রাম বিভাজন ঘুচে গেছে, রুচির মানদণ্ডও সস্তা বিনোদনের দিকে চলে গেছে
  • • বিটিভির মান নিয়ন্ত্রণের জায়গা এখন নিয়েছে ইউটিউব ও ভাইরাল-ভিত্তিক মিডিয়া, যেখানে গুণ নয়, জনপ্রিয়তাই মূল মাপকাঠি

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাটক এক সময় ছিল জাতীয় পরিচয়ের গর্ব। জহির রায়হান, আবদুল্লাহ আল মামুন, আমজাদ হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক—তাদের মতো স্রষ্টারা ছিলেন শিল্পের মানদণ্ড। কিন্তু আজকের প্রজন্মের মধ্যে “হিরো আলম” নামটি শীর্ষে চলে আসা মানে শুধু বিনোদনের রুচি বদল নয়, এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সামগ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোর পরিবর্তনের একটি প্রতিফলন।

শিল্পের স্বর্ণযুগ : জহির রায়হান থেকে সৈয়দ শামসুল হক
১৯৬০–৭০-এর দশকে বাংলাদেশের নাটক, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র ছিল সমাজ-মানস ও ইতিহাসের গভীর প্রতিফলন।

  • জহির রায়হান:“জীবন থেকে নেয়া”-র মতো রাজনৈতিক রূপক সিনেমা বানিয়েছিলেন, যা সামরিক শাসনের সমালোচনা করে জনগণের কণ্ঠকে তুলে ধরেছিল।
  • আবদুল্লাহ আল মামুন:মঞ্চনাটক এবং টেলিভিশন নাটকে সমাজের বাস্তবতা, প্রান্তিক মানুষের জীবন এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে তুলে এনেছিলেন।
  • আমজাদ হোসেন:“গোলাপী এখন ট্রেনে”-এর মতো চলচ্চিত্রে গ্রামের সমাজচিত্র, নারীর সংগ্রাম, দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন-হতাশা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
  • সৈয়দ শামসুল হক:নাটক ও চলচ্চিত্রের সংলাপকে সাহিত্যের উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, ভাষার শৈলী এবং দর্শনের গভীরতা এনেছিলেন।

তাদের কাজগুলো শুধুমাত্র বিনোদন ছিল না—এগুলো ছিল শিক্ষা, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।

শিক্ষার মানের অবনতি

বর্তমান বিনোদন রুচির পরিবর্তনের পেছনে শিক্ষা ব্যবস্থার অবক্ষয় অন্যতম কারণ।

  • সাহিত্যের পাঠ ক্রমে কমেছে। স্কুল-কলেজে নাটক বা চলচ্চিত্র-ভাষ্য বিশ্লেষণ শেখানো হয় না।
  • সাধারণ পাঠ্যক্রমে সৃজনশীল ও সমালোচনামূলক চিন্তা বিকাশে জোর নেই।
  • মানুষ সিনেমা বা নাটক দেখে শুধুই“মজা” বা “হাসি” খোঁজে, চিন্তা বা বার্তা নয়।

ফলত, দর্শকের রুচি সহজ, সস্তা বিনোদনে নামছে।

রাজনৈতিক পরিবেশ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব
এক সময় রাষ্ট্র নাটক ও চলচ্চিত্রকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখত।

  • টেলিভিশন নাটকের“স্বর্ণযুগে” বিটিভি মান নিয়ন্ত্রণ করত, ভালো লেখক-পরিচালকদের সুযোগ দিত।
  • এখন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায় বাণিজ্যিক প্রযোজক ও ইউটিউব-ভিত্তিক তারকারা,যারা নিম্নরুচির কন্টেন্ট ছড়ায়।
  • সিনেমা হল নষ্ট হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা,বিনিয়োগ সংকট ও অনিশ্চয়তার কারণে।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন

  • শহর-গ্রাম বিভাজন কমেছে,ডিজিটাল মাধ্যমের বিস্তারে সবাই সহজ বিনোদন খুঁজছে।
  • ইউটিউব,ফেসবুক—সবখানে অল্প খরচে ভিডিও বানানো যায়। দর্শক শিক্ষিত হোক বা না হোক, যে কেউ “তারকা” হতে পারে।
  • সমাজে সংলাপের ভাষা ও রুচি সাধারণ হয়েছে।“বড়লোক-গরিব” বিভাজন নেই—এখন সকলেই কমেডি বা ভাইরাল কনটেন্টে হাসে।

ফলে, সমাজের যে অংশটি আগে জহির রায়হান বা আমজাদ হোসেনকে সমর্থন করত, তারাও এখন “হিরো আলম”-এর ভিডিও দেখে মজা পায়।

সমাধান কোথায়?

  • শিক্ষায় সংস্কৃতি ও শিল্পের গুরুত্ব বাড়ানো দরকার। নাটক,সিনেমা ও সাহিত্যকে পাঠ্যক্রমে জায়গা দিতে হবে।
  • সরকারী অনুদান বণ্টনে গুণগত মানের ভিত্তিতে নির্বাচন করতে হবে।
  • টেলিভিশন ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোকে মান নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার।
  • নতুন প্রজন্মের লেখক,নির্মাতা ও অভিনেতাদের উৎসাহ দিতে হবে।

বাংলাদেশের বিনোদন জগতের মান কোনো এক দিনে পড়ে যায়নি। এটি বহু বছর ধরে শিক্ষা, রাজনীতি ও সমাজের রুচির অবক্ষয়ের ফল। জহির রায়হান, আবদুল্লাহ আল মামুন, আমজাদ হোসেন, সৈয়দ শামসুল হকের উত্তরাধিকার রক্ষা করতে হলে আমাদের এই সমস্যাগুলোর শিকড়ে হাত দিতে হবে। নাহলে “হিরো আলম” বা তার চেয়েও নিম্নমানের “তারকা” আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ন্ত্রণ করবে।