ঢাকা শহরের নামকরা খাবারের তালিকায় ‘নান্না বিরিয়ানি’ এক কিংবদন্তি। পুরনো ঢাকার গলিপথ পেরিয়ে যে সুগন্ধ মশলার ঘ্রাণ নাকে আসে, তারই অন্যতম প্রধান উৎস নান্না বিরিয়ানি হাউজ। প্রায় কয়েক দশক ধরে এই দোকান ঢাকাবাসীর কাছে শুধু একটি খাবারের নাম নয়, একটি ঐতিহ্য।
ইতিহাস ও শুরুর গল্প
নান্না বিরিয়ানির শুরুর দিনগুলো খুব সাধারণ ছিল। জানা যায়, ষাট-সত্তরের দশকে পুরান ঢাকার ইসলামপুর এলাকায় নান্না মিয়া নামে এক রাঁধুনি ছোট পরিসরে বিরিয়ানি রান্না করে বিক্রি করতেন। তার বিরিয়ানির স্বাদ এতই বিখ্যাত হয়ে যায় যে ধীরে ধীরে দোকান বড় হয়, নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো ঢাকায়। নান্না মিয়া ছিলেন রান্নার খুঁতখুঁতে কারিগর—মশলার মাপজোক, চালের মান, গরুর মাংসের গুণ—সবকিছুতেই তাঁর নজর থাকত।
স্বাদের রহস্য
নান্না বিরিয়ানির বিশেষত্ব এর মসলার মিশ্রণ। দোকানিরা বলে থাকেন, এটি ‘গোপন মশলা’ যা পরিবারগতভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। ঘি, দুধ, কেওড়া, জাফরান—সবকিছু এক নিখুঁত ভারসাম্যে ব্যবহার করা হয়। চাল হিসেবে বেছে নেওয়া হয় উৎকৃষ্ট মানের বাসমতি বা কালিজিরা চাল। মাংস সেদ্ধ হয় ধীরে ধীরে, যাতে মশলার আসল স্বাদ মাংসে মিশে যায়।
ঢাকার খাবারের সংস্কৃতিতে নান্না বিরিয়ানির স্থান
ঢাকার খাবারের কথা বলতে গেলে নান্না বিরিয়ানির নাম না নিয়ে উপায় নেই। বিয়ে, আকিকা, ঈদ, মিলাদ—সব অনুষ্ঠানে নান্না বিরিয়ানির কেটারিং অর্ডার দেওয়া হতো এবং এখনো দেওয়া হয়। ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে আসেন শুধু নান্না বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য। এক অর্থে বলা যায়, এটি ঢাকার খাবারের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
দোকানের পরিবেশ ও সেবার ধরন
নান্না বিরিয়ানি হাউজের পরিবেশ খুব বেশি বিলাসবহুল নয়। এটি বরং সরল, রুক্ষ—যেমন পুরান ঢাকার অধিকাংশ খাবারের দোকান। টিনের চাউনি, প্লাস্টিকের চেয়ার, কাঁচের ডিসপ্লেতে সজ্জিত বিরিয়ানি। তবে, গ্রাহকরা আসেন স্বাদের টানে, সাজের জন্য নয়। দোকানের কর্মচারীরা অভ্যস্ত বিরাট ভিড় সামলাতে—যেন এক ধরনের ছন্দে চলে সবকিছু।
মেনু ও বৈচিত্র্য
নান্না বিরিয়ানির মূল আকর্ষণ গরুর বিরিয়ানি। তবে সময়ের সাথে সাথে তারা খাসির বিরিয়ানি, মুরগির বিরিয়ানি, কাবাব, রেজালা, বোরহানিও যোগ করেছে মেনুতে। তবে সবার পছন্দের শীর্ষে থেকে গেছে ঐতিহ্যবাহী গরুর বিরিয়ানি।
চ্যালেঞ্জ ও আধুনিক প্রতিযোগিতা
ঢাকায় এখন বিরিয়ানির অনেক আধুনিক রেস্টুরেন্ট হয়েছে। বাণিজ্যিক চেইন শপ, স্টাইলিশ ক্যাফে—সবখানেই বিরিয়ানি পাওয়া যায়। কিন্তু নান্না বিরিয়ানি এখনো টিকে আছে তার নিজস্ব স্বাদ আর ঐতিহ্যের কারণে। তারপরও, বাড়তি ভিড়, স্থানের সীমাবদ্ধতা, খাবারের দাম, মান নিয়ন্ত্রণ—সবই চ্যালেঞ্জ হিসেবে আছে।
ভোক্তাদের অভিজ্ঞতা ও মতামত
যারা নান্না বিরিয়ানি খান, তারা বলেন, এই বিরিয়ানির স্বাদ ‘ঘরের স্বাদের’ কাছাকাছি। অনেকেই মনে করেন, ঢাকায় এত মশলাদার, এত সুগন্ধি আর ভারী স্বাদের বিরিয়ানি আর নেই। অনেকে অবশ্য অভিযোগ করেন, এখনকার তুলনায় আগের স্বাদ ছিল আরও ভালো। তবে, এ ধরনের নস্ট্যালজিয়া সব ঐতিহ্যবাহী খাবারের সাথেই জড়িয়ে থাকে।
জীবনের অংশ
নান্না বিরিয়ানি শুধু একটি দোকান নয়—ঢাকার জীবনের এক অংশ। পুরান ঢাকার ধুলোবালি, ছোট গলি, ঠাসাঠাসি—সবকিছুর মাঝেও এই বিরিয়ানি টিকে আছে তার স্বাদের কারণে। ঢাকার খাবারের মানচিত্রে এটি একটি অমলিন চিহ্ন। যারা ঢাকায় আসেন, তাদের জন্য নান্না বিরিয়ানি খাওয়া যেন এক অবধারিত অভিজ্ঞতা।
যা-ই হোক, নান্না বিরিয়ানি শুধু খাবার নয়—একটি ঐতিহ্য, যা ঢাকার ইতিহাস আর মানুষের গল্প বয়ে নিয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।