০৬:৪৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

পুরানো ঢাকার রয়্যাল সিনেমা হল: যেখানে অভিনেতারই প্রথম দেখতেন তার ছায়াছবি

পুরানো ঢাকার বিনোদনজগৎ ও রয়্যাল সিনেমা হল

পুরানো ঢাকা ইতিহাসে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মাত্র নয়, বিনোদন ও সংস্কৃতির জন্যও এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তারই অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছিল “রয়্যাল সিনেমা হল” – যা একসময় ঢাকার মানুষের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে অভিজাত ও বর্ণাঢ্য করে তুলেছিল। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাকিস্তান যুগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দশক পর্যন্ত এই হল ঢাকার বিনোদন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ব্রিটিশ আমল: আধুনিকতার স্পর্শে জন্ম

রয়্যাল সিনেমা হলের সূচনা ব্রিটিশ শাসনামলের শেষাংশে – আনুমানিক ১৯৩০–৪০ এর দশকে। তখন ঢাকায় সিনেমা হল বলতে ছিল হাতে গোনা কয়েকটি।

নকশা ও পরিবেশ: কলকাতার আধুনিক হলগুলোর আদলে এটি তৈরি হয়েছিল। উঁচু ছাদ, সুন্দর সজ্জা, মার্বেল ফ্লোর আর রঙিন আলো ছিল দর্শকদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা।

দর্শক শ্রেণি: প্রথম দিকে উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষই প্রধান দর্শক ছিলেন। সরকারি আমলারা, জমিদার পরিবার, কলকাতা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এখানে এসে ছবি দেখতেন।

চলচ্চিত্র: ব্রিটিশ প্রযোজিত ইংরেজি ছবি, বিশেষ করে ঐতিহাসিক বা অ্যাডভেঞ্চার ধাঁচের ছবি দেখানো হতো। ‘দ্য থিফ অব বাগদাদ’, ‘রবিন হুড’ ইত্যাদি ছবি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

পাকিস্তান শাসনামল: বিনোদনের রঙিন বিস্তার

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে যায়। মধ্যবিত্তের বিস্তৃতির সাথে সিনেমা হলের দর্শকবৃত্তও প্রসারিত হয়।

রয়্যালের আধুনিকায়ন: ৫০–৬০ এর দশকে রয়্যাল সিনেমা হলে নতুন আসন, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম, ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করা হয়।

উর্দু ও বাংলা ছবি: পাকিস্তান আমলে উর্দু ছবির সোনালি যুগ – ‘আরমান’, ‘দুলহন এক রাত কি’ ইত্যাদি। এর পাশাপাশি কলকাতার বাংলা ছবি – উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবি – নিয়মিত চলত।

দর্শক সংস্কৃতি: ঈদ, পূজা বা বড় উৎসবের সময় অগ্রিম টিকিট কাটতে লাইন দিতো। পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া হতো এক প্রকার সামাজিক রীতি ছিলো তখন।

১৯৭১ এর পর: বাংলাদেশের প্রারম্ভিক যুগে নতুন আশা

স্বাধীনতার পর ৭০–৮০ এর দশকের শুরুতে দেশ পুনর্গঠন চললেও সিনেমা ছিল মানুষের বড় বিনোদন।

বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ: ‘রঙিন ছবি’ আসার পর রয়্যাল হল হয়ে ওঠে নতুন বাংলা ছবির প্রিমিয়ার শোয়ের ঠিকানা। আলমগীর, কবরী, বুলবুল আহমেদ, সুচন্দা – এদের ছবি হলে চলত মাসের পর মাস।

প্রিমিয়ার শো ও তারকা আসা: তখনকার স্টাররা প্রিমিয়ারে আসতেন। সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হতো – ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজে এটিকে এক গ্ল্যামার ভাবা হতো।

টিকিটের দাম ও সেবা: সাধারণ মানুষের জন্য গ্যালারি, মধ্যবিত্তের জন্য ব্যালকনি – শ্রেণীভেদ থাকলেও সবাই উপভোগ করতেন ছবি।

আটের দশকের শুরুর কাল: শেষ উজ্জ্বল দিনগুলো

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বাণিজ্যিক রঙিন ধারার উত্থানও রয়্যাল হলকে আলোয় রাখে।

রোমান্টিক ও সামাজিক ছবি: ‘দুই জীবন’, ‘শেষ ঠিকানা’, ‘অশিক্ষিত’ – এসব ছবি দীর্ঘদিন চলত।

ঈদে ব্লকবাস্টার: ঈদ রিলিজের ছবি মানেই টিকিটের জন্য বিশাল লাইন। পুলিশের পাহারা রাখতে হতো।

পরিবারকেন্দ্রিক পরিবেশ: তখনও হলের পরিবেশ মোটামুটি শৃঙ্খলাপূর্ণ, পরিবার নিয়ে যাওয়া যেত। এটি ছিল শহরের সম্মানজনক বিনোদনকেন্দ্র।

পতন ও বিলুপ্তি
আটের দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকে ভিডিও ক্লাব, বিদেশি ভিডিও ফিল্ম, স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রভাব আসতে শুরু করে।

দর্শক কমা শুরু: নব্বইয়ের দিকে শহরের মানুষ টিভি আর ভিডিও প্লেয়ারে ছবি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাব: মালিকপক্ষও নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হয়নি। সাউন্ড, প্রজেকশন, আসন – সবকিছুর মান পড়ে যায়।

ধীরে ধীরে বন্ধ: এক সময় সিনেমা শো কমানো হয়। পরে হলটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

স্মৃতি ও নস্টালজিয়া
আজ রয়্যাল সিনেমা হল নেই –বহুতল ভবন হয়েছে তার জায়গায়। কিন্তু ঢাকার পুরানো দিনের মানুষ এখনও মনে করেন সেই দিনের উজ্জ্বল পর্দা, বালকনির ঠান্ডা বাতাস, গেটের বাইরে কোল্ড ড্রিংকের দোকান, ভেতরে ছবি শুরুর ঘণ্টা – সবই তাদের জীবনের অমূল্য স্মৃতি।

রয়্যাল সিনেমা হল ছিল শুধু বিনোদনের জায়গা নয় – এটি ছিল ঢাকার নাগরিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আজও তার গল্প শোনালে শোনা যায় ঢাকার হারানো ঐতিহ্যের কথা।

পুরানো ঢাকার রয়্যাল সিনেমা হল: যেখানে অভিনেতারই প্রথম দেখতেন তার ছায়াছবি

১১:০০:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫

পুরানো ঢাকার বিনোদনজগৎ ও রয়্যাল সিনেমা হল

পুরানো ঢাকা ইতিহাসে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মাত্র নয়, বিনোদন ও সংস্কৃতির জন্যও এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তারই অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছিল “রয়্যাল সিনেমা হল” – যা একসময় ঢাকার মানুষের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে অভিজাত ও বর্ণাঢ্য করে তুলেছিল। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাকিস্তান যুগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দশক পর্যন্ত এই হল ঢাকার বিনোদন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ব্রিটিশ আমল: আধুনিকতার স্পর্শে জন্ম

রয়্যাল সিনেমা হলের সূচনা ব্রিটিশ শাসনামলের শেষাংশে – আনুমানিক ১৯৩০–৪০ এর দশকে। তখন ঢাকায় সিনেমা হল বলতে ছিল হাতে গোনা কয়েকটি।

নকশা ও পরিবেশ: কলকাতার আধুনিক হলগুলোর আদলে এটি তৈরি হয়েছিল। উঁচু ছাদ, সুন্দর সজ্জা, মার্বেল ফ্লোর আর রঙিন আলো ছিল দর্শকদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা।

দর্শক শ্রেণি: প্রথম দিকে উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষই প্রধান দর্শক ছিলেন। সরকারি আমলারা, জমিদার পরিবার, কলকাতা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা এখানে এসে ছবি দেখতেন।

চলচ্চিত্র: ব্রিটিশ প্রযোজিত ইংরেজি ছবি, বিশেষ করে ঐতিহাসিক বা অ্যাডভেঞ্চার ধাঁচের ছবি দেখানো হতো। ‘দ্য থিফ অব বাগদাদ’, ‘রবিন হুড’ ইত্যাদি ছবি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

পাকিস্তান শাসনামল: বিনোদনের রঙিন বিস্তার

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে যায়। মধ্যবিত্তের বিস্তৃতির সাথে সিনেমা হলের দর্শকবৃত্তও প্রসারিত হয়।

রয়্যালের আধুনিকায়ন: ৫০–৬০ এর দশকে রয়্যাল সিনেমা হলে নতুন আসন, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম, ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করা হয়।

উর্দু ও বাংলা ছবি: পাকিস্তান আমলে উর্দু ছবির সোনালি যুগ – ‘আরমান’, ‘দুলহন এক রাত কি’ ইত্যাদি। এর পাশাপাশি কলকাতার বাংলা ছবি – উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবি – নিয়মিত চলত।

দর্শক সংস্কৃতি: ঈদ, পূজা বা বড় উৎসবের সময় অগ্রিম টিকিট কাটতে লাইন দিতো। পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া হতো এক প্রকার সামাজিক রীতি ছিলো তখন।

১৯৭১ এর পর: বাংলাদেশের প্রারম্ভিক যুগে নতুন আশা

স্বাধীনতার পর ৭০–৮০ এর দশকের শুরুতে দেশ পুনর্গঠন চললেও সিনেমা ছিল মানুষের বড় বিনোদন।

বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগ: ‘রঙিন ছবি’ আসার পর রয়্যাল হল হয়ে ওঠে নতুন বাংলা ছবির প্রিমিয়ার শোয়ের ঠিকানা। আলমগীর, কবরী, বুলবুল আহমেদ, সুচন্দা – এদের ছবি হলে চলত মাসের পর মাস।

প্রিমিয়ার শো ও তারকা আসা: তখনকার স্টাররা প্রিমিয়ারে আসতেন। সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হতো – ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজে এটিকে এক গ্ল্যামার ভাবা হতো।

টিকিটের দাম ও সেবা: সাধারণ মানুষের জন্য গ্যালারি, মধ্যবিত্তের জন্য ব্যালকনি – শ্রেণীভেদ থাকলেও সবাই উপভোগ করতেন ছবি।

আটের দশকের শুরুর কাল: শেষ উজ্জ্বল দিনগুলো

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বাণিজ্যিক রঙিন ধারার উত্থানও রয়্যাল হলকে আলোয় রাখে।

রোমান্টিক ও সামাজিক ছবি: ‘দুই জীবন’, ‘শেষ ঠিকানা’, ‘অশিক্ষিত’ – এসব ছবি দীর্ঘদিন চলত।

ঈদে ব্লকবাস্টার: ঈদ রিলিজের ছবি মানেই টিকিটের জন্য বিশাল লাইন। পুলিশের পাহারা রাখতে হতো।

পরিবারকেন্দ্রিক পরিবেশ: তখনও হলের পরিবেশ মোটামুটি শৃঙ্খলাপূর্ণ, পরিবার নিয়ে যাওয়া যেত। এটি ছিল শহরের সম্মানজনক বিনোদনকেন্দ্র।

পতন ও বিলুপ্তি
আটের দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকে ভিডিও ক্লাব, বিদেশি ভিডিও ফিল্ম, স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রভাব আসতে শুরু করে।

দর্শক কমা শুরু: নব্বইয়ের দিকে শহরের মানুষ টিভি আর ভিডিও প্লেয়ারে ছবি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাব: মালিকপক্ষও নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী হয়নি। সাউন্ড, প্রজেকশন, আসন – সবকিছুর মান পড়ে যায়।

ধীরে ধীরে বন্ধ: এক সময় সিনেমা শো কমানো হয়। পরে হলটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

স্মৃতি ও নস্টালজিয়া
আজ রয়্যাল সিনেমা হল নেই –বহুতল ভবন হয়েছে তার জায়গায়। কিন্তু ঢাকার পুরানো দিনের মানুষ এখনও মনে করেন সেই দিনের উজ্জ্বল পর্দা, বালকনির ঠান্ডা বাতাস, গেটের বাইরে কোল্ড ড্রিংকের দোকান, ভেতরে ছবি শুরুর ঘণ্টা – সবই তাদের জীবনের অমূল্য স্মৃতি।

রয়্যাল সিনেমা হল ছিল শুধু বিনোদনের জায়গা নয় – এটি ছিল ঢাকার নাগরিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আজও তার গল্প শোনালে শোনা যায় ঢাকার হারানো ঐতিহ্যের কথা।