প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য পেল ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পশ্চিম শিয়া সম্রাটদের সমাধি কমপ্লেক্সকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে এই স্থাপনার গুরুত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলো।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই স্বীকৃতি ঘোষণা করা হয়। এই বিশাল সমাধি কমপ্লেক্সকে “শি শিয়া ইম্পেরিয়াল টুম্বস” নামেও ডাকা হয়।
পশ্চিম শিয়া রাজবংশের ইতিহাস
সমাধি এলাকা পশ্চিম শিয়া রাজবংশ (১০৩৮–১২২৭ খ্রিস্টাব্দ)-এর আমলের। এই রাজবংশ ট্যাংগুট জনগোষ্ঠী দ্বারা শাসিত ছিল, যারা প্রাচীন কিয়াং জাতিগোষ্ঠীর একটি শাখা হিসেবে পরিচিত। এটি উত্তর-পশ্চিম চীনের নিংশিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী ইয়িনচুয়ান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
সমাধি কমপ্লেক্সের বিস্তৃতি ও নকশা
৪০ বর্গকিলোমিটারের এই বিশাল এলাকায় রয়েছে ৯টি রাজকীয় সমাধি এবং ২৭১টি অধস্তন সমাধি। এছাড়া রয়েছে ৩২টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং পাঁচ হেক্টর আয়তনের একটি বিশেষ অংশ যেখানে উপাসনা ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো।
বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এই এলাকা বিভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনের জীবন্ত প্রমাণ।
সবচেয়ে বড় এবং সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
চীনের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রশাসন (NCHA) জানিয়েছে, এটি পশ্চিম শিয়া যুগের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা। এখান থেকে প্রায় ৭,১০০ প্রত্নসম্পদ উদ্ধার হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অলঙ্কৃত ছাদের অংশ, শিলালিপি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, অস্ত্র ও বর্মের টুকরো, বলি দেওয়া পশুর মূর্তি, পশুর কঙ্কাল এবং বিভিন্ন গহনা।
পশ্চিম শিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত গুরুত্ব
পশ্চিম শিয়া রাজ্য ছিল সিংহুয়া-তিব্বত মালভূমি এবং অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে অবস্থানরত। পূর্বদিকে ছিল হলুদ নদী এবং পশ্চিমে ইউমেন পাস (জেড গেট পাস), যা সিল্ক রোডের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণে শিয়াওগুয়ান পাস এবং উত্তরে গোবি মরুভূমির অংশ বিস্তৃত ছিল।
NCHA জানিয়েছে, “এটি সিল্ক রোডের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ন্ত্রণ করত।”
ট্যাংগুট জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি ও স্থানান্তর
ট্যাংগুটরা ছিল যাযাবর জনগোষ্ঠী, যারা আজকের কিংহাই এবং সিচুয়ান প্রদেশের উপত্যকায় বাস করত। তুয়োবা উপজাতি এদের নেতৃত্বে উঠে আসে এবং সপ্তম শতকের গোড়ায় ট্যাং রাজবংশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ট্যাং সম্রাটের দেওয়া “লি” পদবি তারা পশ্চিম শিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বহাল রাখে। পরে তিব্বতীয় সাম্রাজ্যের চাপের কারণে তাদের নিংশিয়া, গানসু এবং শানশি প্রদেশে স্থানান্তরিত হতে হয়।
ফেং শুই নকশার প্রভাব
NCHA-র বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ট্যাংগুট শাসকরা প্রাচীন চীনা ফেং শুই তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। সমাধি কমপ্লেক্সের নকশা ও অবস্থান প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এলাকা দক্ষিণ-পূর্বমুখী, পেছনে উত্তর-পশ্চিমে পাহাড় এবং পূর্বদিকে ইয়িনচুয়ান শহর ও হলুদ নদী। প্রতিটি সমাধির কেন্দ্ররেখা হেলান পর্বতের একটি নির্দিষ্ট শিখরের সাথে সঙ্গতি রেখে তৈরি।
স্থাপত্য শৈলী ও বৈশিষ্ট্য
এই সমাধি কমপ্লেক্সে প্রাচীন চীনা সমাধি স্থাপত্যশৈলীর স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যদিও বেশির ভাগ কাঠামো মাটি ঠেসে তৈরি, তাতে কাঠ ও ইটের ব্যবহার করা হয়েছে যাতে কাঠের নকশা অনুকরণ করা যায়।
এছাড়া কিছু ব্যতিক্রমী স্থাপনা আছে, যেমন সমাধি প্যাগোডা এবং বৃত্তাকার স্টিল প্যাভিলিয়ন, যা অন্য কোনো যুগের সমাধি স্থাপত্যে দেখা যায় না। সমাধি কক্ষগুলো মাটির গুহার মতো এবং এর ভেতর কাঠের ফলক দিয়ে আচ্ছাদিত, যা ট্যাংগুটদের মাটির ঘরে বসবাসের ঐতিহ্যের প্রতিফলন।
রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিক স্বীকৃতি
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের ১২২৭ সালের আক্রমণের পর পশ্চিম শিয়া রাজবংশ বিলুপ্ত হয় এবং সমাধিগুলো ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে নিংশিয়া জাদুঘর প্রথম সার্ভে করে এবং খনন কাজ শুরু করে। ১৯৮৮ সালে এটি চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বোচ্চ সুরক্ষা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির মাধ্যমে চীনের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের সংখ্যা ৬০-এ পৌঁছেছে। চীনের সংস্কৃতি ও পর্যটন উপমন্ত্রী রাও ছুয়ান বলেছেন, “চীন বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশনের বাধ্যবাধকতা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে” এবং সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে আরও সক্ষমতা ও মানোন্নয়ন করবে।